নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

আইনশৃঙ্খলা সভায় সিইসির নির্দেশনা

ভোট ভাগ্য আমরা মাস্তানদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সেই নির্বাচনের অবস্থা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তখন ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঘটনার আলোকে আমাদের এবারের নির্বাচনের প্রস্তুতির রূপরেখা ও কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, দুই দিন ধরে নির্বাচনী প্রচারের সহিংসতার ঘটনা ওই নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির পাঁয়তারা কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, ‘আর যেন সেই পাঁয়তারা না হয়। ভোটভাগ্য আমরা মাস্তানদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।’ আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনে গতকাল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক সমন্বয় সভায় বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম, বেগম কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর প্রধান ও প্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান ও প্রতিনিধিরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বিস্তারিত আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররাও উপস্থিত ছিলেন।নুরুল

সিইসি নুরুল হুদা বলেন, ‘তখন মাঠে সব বাহিনী ছিল। সশস্ত্র বাহিনী ছিল, পুলিশ বাহিনী ছিল, র‌্যাব ছিল, বিজিবি ছিল। তবু আমরা কী দেখেছিলাম! পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছিল, প্রিসাইডিং অফিসার নিহত হয়েছিল, ম্যাজিস্ট্রেট নিহত হয়েছে, শত শত মানুষ নিহত হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত হয়েছে। সেটা কোনো পরিপ্রেক্ষিত ছিল, আমরা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনিÑ সে প্রসঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ ও প্রয়োজন নেই। তবে ভবিষ্যতে এ বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। এটি ভুলে গেলে চলবে না।’

নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, সেই অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আবার যাতে সে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আপনাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য) দায়িত্ব জনগণের জীবন রক্ষা করা, মালামাল রক্ষা করা, সম্পদ রক্ষা ও দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করব, আপনাদের যে নিরপেক্ষ ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আছে, তা দিয়ে এবং দক্ষতা ও মানসিকতা কাজে লাগিয়ে এবারের নির্বাচনে আমরা এসব মোকাবিলা করতে পারব। এ বছর যেন আর সে রকম তান্ডব না ঘটে; সে রকম পরিস্থিতির সুযোগ যেন সৃষ্টি না হয়। এখন থেকে সেটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে।’

কেএম নুরুল হুদা বলেন, ‘আমরা কিন্তু আশঙ্কাগুলো একেবারেই অবহেলা করতে পারি না। যেদিন প্রতীক বরাদ্দ হলো তার পরদিনই দুর্ঘটনা। সে ঘটনাগুলো যত ছোটই হোক না কেন, দুটো জীবন চলে গেল। সে দুটো জীবনের মূল্য অনেক। কিন্তু কেন হলো? তারপরে এখানে ওখানে ভাঙচুর, প্রতিহত করা। এগুলোর পেছনে কি রাজনৈতিক, সামাজিক কারণ, নাকি সেই ২০১৪ সালের মতো ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে কি না; তা কিন্তু ভালোভাবে নজরে নিতে হবে।নুরুলগোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্ক নজরদারি থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘একটা ঘটনা ঘটে গেল একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতিনুরুলথেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হালকাভাবে নিলে হবে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সতর্ক অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে তৃতীয় কোনো শক্তির ষড়যন্ত্র আছে কি না, খতিয়ে দেখতে হবে। গোয়ান্দা সংস্থাগুলোর প্রতি অনুরোধ জানাব সতর্ক নজরদারি রাখার।’

সিইসি আরো বলেন, নির্বাচন নিয়ে যখন স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখনই খুনের ঘটনা, হামলার ঘটনা, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এ দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হোক, তা না চাওয়ার দলের প্রভাবশালী মহল সক্রিয় থাকতেও পারে। তাদের বিষয়ে সবার বিশেষ করে নির্বাচন কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমাজের সচেতন মহল ও জনগণের সচেতন থাকা প্রয়োজন।

ইভিএম প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘এবার আমরা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করতে চাই। জনগণের ভোট মাস্তানদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। বাক্স ছিনতাইকারীদের হাত থেকে ভোটারদের মুক্তি দিতে হবে। সে পদ্ধতির পরিবর্তে আরেকটি পদ্ধতি আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন মনে করে ইভিএম সে রকম একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমেনুরুলভোটারদের ভোটের নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হবে। আমরা ছয়টি এলাকায় ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছি। সে ছয়টি এলাকায় যার যার দায়িত্ব তাদেরকে অনুরোধ করব, সেগুলোর দিকে আলাদাভাবে দৃষ্টি দেওয়া, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেবেন।’

তিনি বলেন, ইভিএম সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ অনিয়ম দূরীভূত হবে বলে বিশ্বাস করি।নুরুলসবগুলো নির্বাচন ইভিএমের আওতায় আনার একটি অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। ইভিএম ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের অনিয়ম দূর করার এটাই একমাত্র এবং নির্ভরযোগ্য পন্থা। নির্বাচনসংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্য করে সিইসি বলেন, দায়িত্ব পালনকালেনুরুলপেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে সব বাহিনীর কৌশল ঠিক করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সব থেকে বেশি তথ্য-উপাত্ত থাকে। তথ্য-উপাত্তগুলো প্রয়োগ করে অন্য সব বাহিনীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সব গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে এবং এতে বিজিবিকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন হবে। কারণ এতে তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

সিইসি বলেন, আপনারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নজরদারি রাখবেন। নারী ভোটারদের নিরাপত্তার বিষয়টিও আলাদাভাবে খেয়াল রাখবেন। যাতে ভোট দিয়ে তারা নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। প্রত্যেক এলাকার মাস্তান ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের তালিকা তৈরি করতে হবে। যেটা আপনারা সব সময় করে থাকেন। সেটা এখন থেকেই তৈরি করতে হবে। ভোটের ভাগ্য সন্ত্রাসীদের হাতে দেওয়া যাবে না। সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে তাদের আটক করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সিইসি আরো বলেন, গত ২০১৪ সালের সহিংস অবস্থার কথা মাথায় রেখে নিরাপত্তার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বিনা কারণে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। কারো বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা যাবে না। সংঘবদ্ধভাবে প্রজাতন্ত্রের সব বিভাগ নির্বাচনের দায়িত্বে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সংবিধান ও আরপিওর বলে, এখন সব দায়িত্ব আপনাদের কাছে। নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দেশের নাগরিক তাদেরকেও সম্পৃক্ত থাকার জন্য অনুরোধ করব। সকলকেই সঙ্গে নিয়েই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। সিইসি বলেন, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছি। এরই মধ্যে প্রস্তুতির ৯৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু ব্যালট পেপার ছাপানো সংক্রান্ত কিছু কাজ বাকি আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close