বিশেষ প্রতিনিধি

  ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮

ফিরে আসে বিজয়

একাত্তরের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে বাংলাদেশ। ঢাকা ছাড়া দেশের অধিকাংশ জেলায় তখন শত্রুমুক্ত। ঢাকাকেও শক্রমুক্ত করতে চারদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে যৌথবাহিনী। ঢাকায় তখন কারফিউ আর ব্ল্যাকআউট। এর মধ্যেই মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমান হামলায় স্তব্ধ হয়ে যায় রেডিও ঢাকা কেন্দ্র। বোমা-রকেট ছুড়ে বিধ্বস্ত করা হয় হয় ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর। আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত লিফলেট ফেলা হয়। মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটা জাহাজভর্তি পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে। উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করে যৌথবাহিনী। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ অভিযানে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রুবাহিনী পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শক্রমুক্ত হয় রংপুর ও দিনাজপুর। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর সময় শহরের অদূরে যৌথবাহিনীর মুখোমুখি হয়। এ যুদ্ধে হতাহত হয় প্রায় দেড় হাজার পাকিস্তানি সেনা। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে।

ভোররাতে ভৈরববাজারের ৩-৪ মাইল দক্ষিণে হেলিকপ্টার করে নামে যৌথবাহিনীর ৫৭নং ডিভিশনের সৈন্য। সারা দিন ধরে অভিযান চলে মেঘনা নদী অতিক্রমের। নদীর ওপারে নেমে ঘাঁটি গেড়ে বসল প্রথম বাহিনীটা। কিছুটা উত্তরে ভৈরববাজারের কাছেই পাকিস্তানি সৈন্যদের তখন বড় একটা মজুদ। ব্রিজটার একটা ভেঙে নদীর পশ্চিম পারে ওত পেতে বসে রয়েছে। সূর্য উঠতেই তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টার। নদী পার হচ্ছে সৈন্যরা। কিন্তু দেখেও ঘাঁটি ছাড়তে সাহস পেল না। ভাবল ওটা বোধহয় মিত্রবাহিনীর ধাপ্পা। ওদিকে ছুটে গেলেই আশুগঞ্জ থেকে মূল মিত্রবাহিনীটা ভৈরববাজার-ঢাকার রাস্তা ধরবে। তাতে সুবিধায় হলো মিত্রবাহিনীর। বিনা বাধায় পার হলো মেঘনা। মেঘনা পেরিয়ে বেশ কয়েক মাইল হেঁটে তারপর তারা পৌঁছাল ভৈরববাজার-ঢাকার মূল সড়কে। পরদিন দখল করল রায়পুরা।

একাত্তরের এদিন ময়মনসিংহ শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডাকবাংলো, কোওয়াটখালী, বড়বাজার, নিউমার্কেট, কালীবাড়ি ও সাহেবআলি রোড এলাকায় বহু নিরীহ সাধারণ মানুষ হত্যা করে। দিবাগত রাতে দৈনিক ইত্তেফাকের বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, পিপিআই সংবাদ সংস্থার প্রধান সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন সৈয়দ নাজমুল হককে আলবদর-আলশামস বাহিনীর খুনিরা তাদের নিজ নিজ বাসভবন থেকে অপহরণ করে। এরপর এ তিনজনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও আত্মসমর্পণের আগে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে শেষ চেষ্টা চালায় বিধ্বস্ত পাকিস্তান শাসকরা।

যুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কায় নিয়াজীর পালানোর গোপন অভিসন্ধি ফাঁস করে দেয় বিবিসি। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে নিয়াজি দম্ভভরে বলেন, কোথায় বিদেশি সাংবাদিকরা, তাদের জানাতে চাই, কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাব না।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে এক বিশাল জনসভায় বলেন, ভারত যুদ্ধবিরতি-সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান প্রত্যাখ্যান বা গ্রহণ-কোনোটাই করেনি। প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনাধীন। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্ভব, যখন বাংলাদেশ সরকার কায়েম হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থী তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে। যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন ও রণকৌশল গ্রহণ করার বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এদিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান করে। গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমা ফেলার কারণে গভর্নর মালেকের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের পদলেহী সরকারও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল (বর্তমান হোটেল শেরাটন) আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত লিফলেট ফেলা হতে থাকে।

এদিন গভর্নর মালিকের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্রসংবরণ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এ আবেদনে আরো লেখা ছিল, যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই।

এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি মালিক-ফরমান আলী বার্তা হিসেবে পরিচিতি পায়। পরদিন তা আবার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বস্তুত রাও ফরমান আলীর প্রস্তাবের সংবাদ ওয়াশিংটনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন সরকার এই প্রস্তাব রদ করার পরামর্শসহ ইয়াহিয়াকে জানান, পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য সপ্তম নৌবহর ইতোমধ্যেই বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হয়েছে। এর ফলে ইয়াহিয়ার মত পরিবর্তিত হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close