বিশেষ প্রতিনিধি

  ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

ফিরে আসে বিজয়

নতুন গতি পায় মুক্তিযুদ্ধ। দেশের পথে যাত্রা শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অগ্রযাত্রায় সর্বত্র পিছু হটতে থাকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। ক্রমেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনী। বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হতে থাকে। সম্মিলিত বাহিনীর দখলে চলে আসে সীমান্ত শহর দর্শনা। আজ ৪ ডিসেম্বর। একাত্তরের এদিন বাংলাদেশে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে ভারতীয় সেনাবাহিনী। অতর্কিত একযোগে প্রচন্ড আক্রমণ চালায় দেশটির সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, করাচি শত্রুর ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে চলে বোমাবর্ষণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশে চলে জোর বিমানযুদ্ধ।

একাত্তরের এই দিনে ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল সি আর দত্ত এবং জেড ফোর্সের মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাট দখলের পর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী শমশেরনগর বিমানবন্দর এবং আখাউড়া রেলস্টেশন দখল করে। ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর দখল করে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ১১ নম্বর সেক্টরে যৌথবাহিনী বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের শক্ত ঘাঁটি কামালপুর বিওপি দখল করে। পাকিস্তান বাহিনী দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন দখলে রাখার সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিন পিএনএস গাজী বিশাখাপত্তম বন্দরের কাছে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়।

ঢাকা ছিল পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এ ঘাঁটিতেই ছিল তাদের জঙ্গিবিমান। পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন (২৮টি) জঙ্গিবিমান। এক স্কোয়াড্রন চীনা মিগ-১৯ আরেক স্কোয়াড্রন মার্কিনি স্যাবার জেট। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তানের বিমান বহরের অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর মিলিত প্রত্যাঘাত, ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ ও নৌবাহিনীর অবরোধের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের চরিত্র এভাবে এদিন থেকেই আমূল বদলে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত হয়। যুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনায় লক্ষ্মীপুর ছিল বিপর্যস্ত।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য দিনটি ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, ‘এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানকে নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।’ এর আগের দিন ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায় বিমান হামলা চালায় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই তারিখে রাতের বেলা পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায় ভারত।

এমনই একসময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখিতপত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান।

যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন বৈঠকের পর বৈঠক করছে। সবাই চরম উদ্বেগ আর চিন্তার মধ্যে। ঠিক তখনই এলো খুশির সংবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রদানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ভেস্তে যায়। পোল্যান্ডও এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে আরো একটি আনন্দের সংবাদ ছিল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা।

যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস না হওয়ায় নতুন করে জ্বলে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানের পরাজয় কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর ও স্বাধীনতাবিরোধীরা তখনো হাল ছাড়েনি। জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবুল আলা মওদুদী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের পেছনে রয়েছে।

এদিন দুপুরে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, আমরা অনেক সহ্য করেছি। এখন শত্রুর প্রতি চরম ধ্বংসাত্মক প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে। রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের উভয় অংশে যুদ্ধ চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় চাপ মোকাবিলা করা হচ্ছে। মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেবে বলে চীন ওয়াদা করেছে। চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফেই এ দিনে পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলার নিন্দা করে ইসলামাবাদকে দৃঢ় সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close