জুবায়ের চৌধুরী

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৮

মাদকবিরোধী অভিযান

১০ মাসে মামলার স্তূপ গ্রেফতার সোয়া লাখ

পৌনে ৩ কোটি ইয়াবা জব্দ

সর্বনাশা মাদক সমাজে জোঁকের মতো জেঁকে বসেছে। এর ভয়াবহতাও সীমা ছাড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই খবর আসছে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে বাবা-মা এমনকি আত্মীয়-স্বজন খুন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। পরিবারের একজন সদস্য মাদকাসক্ত হওয়ায় পুরো পরিবারের সুখ-শান্তি ভেস্তে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক নির্মূল করতে না পারলে দেশের যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনার পর রাজধানীসহ সারা দেশে শুরু হয়েছে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। যা এখনও চলছে। অভিযানে ১০ মাসে সোয়া লাখ মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার। এ সময়ে পৌনে তিন কোটি ইয়াবা জব্দ করা হলেও অন্য মাদকও ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণের।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ মাসে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার হাতে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৪ জন মাদক চোরাকারবারি গ্রেফতার হয়েছে। এসব ঘটনায় সারা দেশে মামলা হয়েছে ৮৯ হাজার ৪৭টি। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে ৭৮ হাজার ৬৭৪টি। র‌্যাব করেছে চার হাজার ৩০৭টি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনিস) করেছে পাঁচ হাজার ১৯টি, বিজিবি এক হাজার ২২টি এবং ১৩টি মামলা দায়ের করেছে কোস্টগার্ড। অভিযানে দুই কোটি ৮৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৬৭ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়; এ সময়ে ২৮৫টি গাঁজার গাছও উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া, পুরিয়া, ফেনসিডিল, অ্যাম্পুল, ক্যান, বিয়ার, গাঁজা, মদসহ অন্য মাদকদ্রব্যও উল্লেখযোগ্য হারে জব্দ করা হয়েছে।

র‌্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, ১ জানুয়ারি থেকে গত ৮ নভেম্বর পর্যন্ত মাদক-সংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৭ হাজার ৭১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ৪ মে থেকে চালানো বিশেষ অভিযানে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে সাত হাজার ৫৩২ জনকে। একই সময়ে চালানো র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ৯ হাজার ৯৯৫০ জনকে গ্রেফতার করে সাজা দিয়েছে। এ সময়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৮৪ জন নিহত হয়েছে। র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, মাদকবিরোধী অভিযান চলমান রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীরা রুট পরিবর্তন করছে। তবে বিষয়টি নজরদারিতে আছে। সুন্দরবনের জলদস্যুদের মতো মাদক নির্মূলেও একটু সময় লাগবে। এতে দীর্ঘস্থায়ী হবে, আর আমরা জয়ী হবই।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কক্সবাজার জেলার নাফ নদী সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট। তারপর মাদক বিক্রেতাদের মাধ্যমে কক্সবাজার থেকে নানান পন্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় ইয়াবার চালান। তবে ইদানীং দেশের অভ্যন্তরে পাওয়া যাচ্ছে মরণ নেশা এ ইয়াবা তৈরির ছোট ছোট কারখানাও। গত ৩ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে শহরের ১ নং বাবুইল এলাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া পায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেখানে ২৫০টি ইয়াবা এবং ইয়াবা তৈরির বিপুল পরিমাণ উপকরণ ও মেশিন জব্দ এবং তিন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। তখন পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতার তিনজন ভারত ও মিয়ানমার থেকে ইয়াবা তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে। এরপর সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা তৈরি করে বড় বড় চালান সীমান্ত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে আসছিল। পরে মাসের ২ তারিখে (ফেব্রুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার হরিপুরে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সেখানে ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান সিউডো ইফিড্রিনসহ অন্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয় কারখানার মালিক হাবিবুর রহমানের স্ত্রী লাকী আক্তারকে। টিনশেড বাড়ির ভেতরে কারখানাটি ছিল পুরোপুরি সিসি টিভি ক্যামেরার আওতায়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ জানান, নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তারা অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক মাদক জব্দ ও কারবারিদের আটক করছেন। অথচ চিহ্নিত মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর কিছুদিন পরই তারা আবার বেরিয়ে আসে। তার মতে, তরুণরা মাদকের প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠছে। তবে অধিদফতরের পক্ষ থেকেও তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে মামলা ও গ্রেফতারের সংখ্যাও। বের হয়ে আসছে মাদক কারবারীদের নতুন নতুন কৌশল। মাদকের বিরুদ্ধে আইন হয়েছে, এতো অভিযান চলছে। প্রায় প্রতিদিনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাদক কারবারিরা মারা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক ‘মাদক কারবারি’ বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। মাদক পাচার বন্ধে স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠনসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এরপরও মাদক পাচার বন্ধ হয়নি।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা জানান, সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে মাদকের সরবরাহ এখন আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে চাহিদা থাকায় মাদক আসছে। মূলত এ কারণে মাদক পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। তবে আগের মতো এখন আর মাদক আসছে না; অনেক কমেছে।

তবে মাদক তথা ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে নানা উদ্যোগের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বিশেষ জোন গঠনের কথা ভাবছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলায় নৌ ইউনিটসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি বিশেষ জোন স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। একই সঙ্গে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন, আলোচনা সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পোস্টার, লিফলেট, স্টিকার, স্যুভেনির প্রকাশ ও বিতরণের কাজও অব্যাহত আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close