নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৫ নভেম্বর, ২০১৮

প্রতিদিনের সংবাদ-ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ সেমিনার

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বন্ধন চিরন্তন

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বন্ধন চিরন্তন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ভারত আমাদের শুধু স্থায়ী প্রতিবেশীই নয়; ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং আত্মিক। ভারতবর্ষের সঙ্গেই আমাদের সংস্কৃতির মিল রয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘সংস্কৃতির বন্ধনই হোক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মূলভিত্তি’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, সংস্কৃতির বন্ধনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বন্ধনটাও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ক্রমেই উন্নততর হচ্ছে। তবে নিঃসন্দেহে সংস্কৃতির বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক যদি আমরা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে সক্ষম না হই, সম্পর্ক বন্ধুসুলভ না থাকে; তাহলে আমাদের একসঙ্গে বসবাস করে এগিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত দুরূহ হবে। এটি আজকে প্রতিষ্ঠিত সত্য।

গতকাল প্রতিদিনের সংবাদ ও ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (আইসিসিআর) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। বিদ্যুৎ, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম এমপির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারটি উদ্বোধন করেন জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম, অ্যাডভোকেট নূরজাহান মুক্তা, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ভারতীয় হাইকমিশন, ঢাকার পরিচালক ড. নীপা চৌধুরী। আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ শিকদার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রোকনউদ্দিন আহমেদ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কলামিস্ট ফনিন্দ্র সরকার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জান্নাত রিমি। সেমিনারে সূচনা বক্তব্য দেন প্রতিদিনের সংবাদের প্রধান সমন্বয়ক এস এম মাহ্্বুবুর রহমান।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলন হক বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক বহু যুগের, বহু শতাব্দীর। আমরা একই দেশ ছিলাম। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ বিভক্ত হয়। পরে পাকিস্তানের জুলুম, অত্যাচার, শোষণ-নির্যাতন এবং বিশেষ করে ভাষার ওপর হামলা ইত্যাদি কারণে আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের মহীয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন আমাদের পাশে। ভারত সরকার এবং সে দেশের জনগণ সেদিন আমাদের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, এমনিভাবে না দাঁড়ালে মাত্র নয় মাসে আমরা দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না। আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়াসহ অস্ত্রের জোগান দিয়েছিল ভারত। সর্বোপরি মিত্রবাহিনী গঠন করে একত্রে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে আমরা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করি।

ভারতের সঙ্গেই আমাদের সংস্কৃতির মিল রয়েছে উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আরো বলেন, ভারত আমাদের স্থায়ী প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং আত্মিক।

তিনি আরো বলেন, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে খুনি মোশতাক আর জিয়ারা আবার সাম্প্রদায়িকতার লালন-পালন শুরু করে। এর মাধ্যমে আবারও আমাদের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এসে সেই সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনাকে শুধু স্তিমিতই করেনি, বরং ধ্বংস করে দিয়েছে। সে জন্য আমাদের মধ্যে চমৎকার সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছে। এতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, সংস্কৃতির এই বন্ধনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বন্ধনটাও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে উন্নতি হচ্ছে এবং নিঃসন্দেহে এই বন্ধন একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

সেমিনারের মুখ্য আলোচক জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, এই উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে যখন চিন্তা করি, তখন দুটি বিষয় সামনে চলে আসে। আমার মতে, এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। এ সমস্যাটির কারণে এই উপমহাদেশ একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে স্বাধীনতার জন্য। আবার যখন মনে হয় এই উপমহাদেশের বড় সম্পদ কোনটি? তখন আমার মনে হয়, এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এখন একদিকে সাম্প্রদায়িকতা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। তবে সংস্কৃতির সম্পর্ক এবং বৈচিত্র্যই অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে বলে তিনি জানান।

তিনি আরো বলেন, আমাদের সংস্কৃতির বন্ধনে ভাষাটা বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির প্রধান বাহন। তবে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে পরস্পর বিনিময়ের অনেক কিছু আছে। ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, নাট্যকলা, নৃত্যকলা, সর্বোপরি আমাদের এই যে মানুষে মানুষে প্রেম, ভালোবাসা, তার যে সম্পর্ক; সেটাও সেখানে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সুতরাং প্রতিবেশী দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্কটাও গুরুত্ব পাক। সম্পর্কটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক। তাহলে এই দুদেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক যে সমস্যাগুলো আছে; সেগুলোর সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম এমপি স্বাগত বক্তব্যে বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান সংস্কৃতির বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্য নিয়ে আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধন চিরন্তন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা যখন স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম, তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন থেকে বাঁচার একটি মাত্র জায়গা ছিল; সেটি ছিল ভারত। এ জন্য আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। ভারত সেদিন মানবতার কারণে এ দেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। এ কারণে আমরা তাদের কাছে ঋণী। তা ছাড়া স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পুরো বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর যেসব শাসকগোষ্ঠী ওই সময় ক্ষমতায় এসেছিল, তারা এই উপমহাদেশে পরস্পর বৈরী মানসিকতা তৈরির চেষ্টা করেছিল বলেও তিনি জানান।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানের বাস্তবতা হলো প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক যদি আমরা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে সক্ষম না হই, অত্যন্ত বন্ধুসুলভ না থাকে; তাহলে আমাদের একসঙ্গে বসবাস করে এগিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত দুরূহ হবে। এটা আজকে প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমাদের অনেক উদ্বৃত্ত সম্পদ আছে আবার প্রতিবেশীর কাছেও অনেক উদ্বৃত্ত সম্পদ আছে, যা আমাদের কাছে নেই। এই উদ্বৃত্ত সম্পদ আবার তার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে ওই সম্পদের আবার আমাদের প্রয়োজন আছে। তাই আমরা যদি উভয়ে মিলেমিশে ওই উদ্বৃত্ত সম্পদ শেয়ার করে ব্যবহার করতে পারি; তাহলে তারাও লাভবান হতে পারে; অন্যদিকে আমরাও লাভবান হতে পারি। আর মিলেমিশে বসবাস করার মধ্যেই রয়েছে সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক মুক্তি।

শামসুজ্জামান খান বলেন, সংস্কৃতি অত্যন্ত শক্তিশালী বিষয়। সংস্কৃতি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছে। তবে ভারতের জনগণের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরো ব্যাপকভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মিডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ শিকদার বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দুঃখে পড়লে ভারতের মানুষ যেমন দুঃখিত হয়; তেমনি ভারতের মানুষ দুঃখের মধ্যে পড়লে বাংলাদেশের মানুষ দুঃখিত হয়। সেটাই আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেখেছি। ভারত আমাদের এক কোটির বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তারা আমাদের খাদ্য দিয়েছে; ট্রেনিং দিয়েছে ও চিকিৎসা দিয়েছে। আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। অনেকেই শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। তাই বাংলাদেশের মানুষও উপলব্ধিতে এনেছে, ভারত হলো আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।

ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক ড. নীপা চৌধুরী বলেন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ় ও গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়াও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বহুমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে প্রতিবেশী দুদেশের জনগণের মধ্যে যে সংস্কৃতির মেলবন্ধন রয়েছে, তা আলাদা গুরুত্ব বহন করে।

তিনি আরো বলেন, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বিশ্বাস করে, এ ধরনের আয়োজন ভারত এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতির বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করবে।

সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নূরজাহান মুক্তা বলেন, সংস্কৃতির বন্ধনে দুদেশকে আবদ্ধ করতে হলে, আমাদের কিছু বিষয়ে আরো জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। তা হলোÑনতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ভারতের ভিসা জটিলতা দূর করতে হবে। এ দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির মিল রয়েছে। এ ছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গেও আমাদের সংস্কৃতির সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আর ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে সস্প্রচার হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ভারতে সম্প্রচার করা হচ্ছে না। এই বৈষম্যগুলো দূর করতে হবে।

অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম এমপি বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে। তবে এখন সংস্কৃতির সম্পর্কটাকে আরো জোরালো করতে হবে ভারতকে।

তিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার একটা উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমি ওই সময় কলকাতায় ছিলাম। প্রতিদিনের মতো সকালে ফোন দিয়ে বাসার খোঁজখবর নিলাম। ওই দিন বিকেলে হঠাৎই শুনলাম গ্রেনেড হামলার কথা। সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের টিভি রুমে গিয়ে বিভিন্ন চ্যানেল দেখতে শুরু করলাম। কিন্তু কোনো চ্যানেলে এ খবরটি সম্প্রচার করছে না। শুধু একটা চ্যানেল ২০ সেকেন্ডের একটা ভিডিও দেখিয়েছিল। তিনি বলেন, ভারতেরও উচিত আমাদের চ্যানেলগুলো সম্প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া, তাহলে দুদেশের সংস্কৃতির আরো বিকাশ ঘটবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close