প্রতীক ইজাজ

  ০৪ নভেম্বর, ২০১৮

সংলাপ ঘিরেই রাজনীতি

সংলাপ ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে দেশের নির্বাচনী রাজনীতি। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দুই নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া তালিকা অনুযায়ী অন্তত আরো চারটি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। এমনকি ঐক্যফ্রন্ট চাইলে ছোট পরিসরে আবারও সংলাপ হতে পারে বলে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে এই সংলাপকে ঘিরে এবং সংলাপ উদ্ভূত-পরবর্তী পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করছে সামনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। সংলাপের দিকেই এখন তাকিয়ে সবাই।

ইতোমধ্যেই অনুষ্ঠিত দুই জোটের সংলাপ ঘিরে রাজনীতিসহ বিভিন্ন মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সংলাপ থেকে অর্জন খুঁজছেন সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিশ্লেষকরা। এখন পর্যন্ত বড় ধরনের অসন্তুষ্টি দেখা যায়নি কারো মধ্যেই। সংলাপ নিয়ে খুশি এবং সংলাপ ফলপ্রসূ বলে দাবি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পক্ষান্তরে কিছুটা অসন্তুষ্টি আছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও তাদের প্রধান শরিক বিএনপির মধ্যে। তবে একেবারেই হতাশ নন এই জোটের নেতারা। তারা মনে করছেন, খোলা মনে আলোচনা হলে সংলাপ সফল হবে। সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে সংলাপের দ্বার খোলা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও। এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষই মনে করছে, এই সংলাপ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অবশ্য সংলাপে অংশ নেওয়ার অপর জোট যুক্তফ্রন্ট সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও সংলাপে আশা দেখছেন। তাদের মতে, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে সংলাপ ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের মধ্যকার বৈরিতা দূর করার একটি শুভ উদ্যোগ। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে প্রত্যাশা মানুষের, তা একমাত্র সংলাপের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। মানুষ চায় সংলাপ সফল হোক। তবে সংলাপের সফলতা নির্ভর করছে দুই পক্ষ কতটা ছাড় দেবে তার ওপর। ফলে সংকটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সংলাপ অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

এমন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আবারও সংলাপের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ জন্য তারা সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল থেকে বিরত থাকতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে গতকাল। চিঠিতে জোটের প্রধান ড. কামাল হোসেন আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে বসতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছেন।

যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘৭ নভেম্বরের পর আর কোনো আলোচনা নয়’ বলে জানিয়েছেন। গতকাল ড. কামাল হোসেনের আবার সংলাপের বসার ইচ্ছের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, সংলাপ দীর্ঘ সময় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এর মধ্যেই হয়ে যাবে। তবে সংলাপের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি জানান, সব মিলিয়ে ৮৫টির মতো রাজনৈতিক দল সংলাপ চেয়েছে। আজ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও আগামীকাল সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপের কথা রয়েছে। এর পরপরই বিভিন্ন ইসলামী দল ও বাম দলের জোটের সঙ্গে সংলাপে বসবেন প্রধানমন্ত্রী। এর বাইরে আরো অন্তত ৩১টি আবেদন জমা পড়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সূত্র মতে, ছোট পরিসরে হলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আরেকবার সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি সংলাপের ব্যাপারে সবাইকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সংলাপ চলাকালীন আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণায় সংলাপের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গতকাল জেলহত্যা দিবসে ঢাকার ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের আলোচনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হোক, আমরা সেটাই চাই। যারা আলাপ করতে চেয়েছে, সংলাপ করতে চেয়েছে, আমরা করেছি। একটা সুন্দর পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। তারা যেসব দাবি-দাওয়া দিয়েছে, যেসব দাবি-দাওয়া আমাদের পক্ষে করা সম্ভব, আমরা বলেছি সেটা করব।

প্রধানমন্ত্রী এমনও বলেন, আলোচনা চলছে, তখন আবার দেখলাম আন্দোলনের কর্মসূচিও তারা দেয়। একদিকে আলোচনা করবে আবার আরেক দিকে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া, এটা কী ধরনের সংলাপ? সেটা আমাদের কাছে বোধগম্য না।

তবে সংলাপ ঘিরে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল এ ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা সতর্ক আছি। কারণ কারো মনে যদি হীন কোনো মতলব থাকে, কেউ যদি আজকে সংলাপে এসে লোকদেখানো অংশ নিয়ে ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি নাশকতার ছক আঁকে, সহিংসতার দিকে পা বাড়ায়, সেদিকেও আমরা সতর্ক আছি। সেটার সমুচিত জবাবের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

সংলাপে খুশি আওয়ামী লীগ। অর্জনও দেখছেন দলের নেতারা। দলের মতে, এই সংলাপের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন ঘিরে যে উত্তাপ তৈরি হচ্ছিল, সেই বরফ গলতে শুরু করেছে। বাকি সংলাপগুলো হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। দলের নীতিনির্ধারকরা এমনও বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে যে কিছুটা অনিশ্চয়তা ও গুমোট ভাব ছিল, তা কাটিয়ে দেওয়া। আর বিরোধীদের দাবি-দাওয়া কতটা সরকার বাস্তবায়ন করবে, সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া।

সংলাপে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতা শ ম রেজাউল করিম বলেন, আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। অন্তত সংবিধানের বাধ্যবাধকতা বুঝতে পেরেছেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। আশা করছি ভবিষ্যতে যারাই সংলাপে আসবেন, তারাও বিষয়টি বুঝবেন। এই আইনজ্ঞ আরো বলেন, ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি বিচার বিভাগের বিষয়। আদালতের বাইরে এ বিষয়ে তার কিছু করার নেই। ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধানে যা আছে সে অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে কোনো কিছুই হবে না।

সংলাপ ‘ফলপ্রসূ হবে’ বলে সংলাপ থেকে বেরিয়েই মন্তব্য করেছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য নেতারাও মনে করেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হবে। সংলাপের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব। তবে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সংবিধানের মধ্য থেকেই কীভাবে সরকারকে দাবিগুলো মানানো যায়, সে চেষ্টা করবে ঐক্যফ্রন্ট। গতকাল ড. কামাল হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, আলোচনার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। একবার আলোচনা করলাম আর সব দাবি আদায় করে নিয়ে এলাম, তা তো ঠিক না। সংবিধানকে কেন্দ্র করে মন খুলে আলোচনা করলে সমাধান সম্ভব। জনগণের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে লক্ষ্য ঠিক করলে সবকিছু করা যায়।

সংলাপে খুশি হতে না পারলেও সংলাপ নিয়ে এখনো আশাবাদী বিএনপি। সংলাপে সুনির্দিষ্ট কোনো ‘অর্জন’ না হওয়ায় অসন্তুষ্টি থাকলেও দলের নেতারা এখনই হাল ছেড়ে দিতে চান না। তারা আরেকটু দেখতে চাইছেন। প্রয়োজনে আবারও আলোচনার পক্ষে তারা। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট সাত দফা দাবি সরকারপ্রধানের কাছে উপস্থাপন করেছেন। এর যুক্তিও তুলে ধরেছেন। এখন বল সরকারের কোর্টে। দাবি মানা না মানা সরকারের ব্যাপার।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ অবস্থায় সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে বা ফলপ্রসূ হয়নি, এখনই এ কথা বলে দেওয়াটা সমীচীন হবে না। নেতারা মনে করছেন, সংলাপ নিয়ে এখনই নেতিবাচক মন্তব্য করলে এর দায়ভার ফেলানো হবে বিএনপির ওপর। তাই দলের নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। শেষ পর্যন্ত সংলাপ হয়েছে। এটাকে একটা ‘অর্জন’ হিসেবে দেখতে চান তারা। তাদের মতে, যে সাত দফা দাবি সংলাপে দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট, সেগুলো সরকার একেবারে নাকচ করে দেয়নি। এ ব্যাপারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আমরা আশা ছাড়িনি। সংলাপ ফলপ্রসূ দেখতে চাই।

তবে সংলাপে খুশি যুক্তফ্রন্ট। ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা সংলাপ শেষে যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, সংলাপে তারা খুশি। যে কথাগুলো বলতে চেয়েছিলেন সেগুলো পরিষ্কারভাবে বলতে পেরেছেন। কয়েকটি দাবিতে সরকারি দলের সঙ্গে মতৈক্য হয়েছে। বি. চৌধুরী এমনও জানান, নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত হলে তারা নির্বাচনে যাবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close