প্রতীক ইজাজ

  ৩০ অক্টোবর, ২০১৮

আজ-কালের মধ্যে সংলাপ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু

ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাবে দ্রুত সাড়া

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরুর ঠিক আগের দিন নতুনমাত্রা পেল নির্বাচনী রাজনীতি। এলো বহু দিন ধরে চলে আসা বেশকিছু নির্বাচনী ইস্যুর ব্যাপারে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশনের চমক দেওয়া সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সম্মতি প্রকাশ। এর ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন সরকারের সদিচ্ছার পুনঃপ্রকাশ ঘটল; তেমনি সংলাপের মধ্য দিয়ে বেশকিছু অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান মিলবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। একইভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিধান রেখে মন্ত্রিসভা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই ইস্যুরও আপাত সমাধান মিলল। বিশেষ করে নির্বাচনী ক্ষণগণনা শুরুর একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারি স্বস্তি এনেছে রাজনীতিতে। এর ফলে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে রাজনীতিতে চলে আসা নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনার অবসান হলো। ক্ষণগণনা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে এসব মেরূকরণকে নির্বাচনী রাজনীতির জন্য সুখবর বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এসবের মধ্য দিয়ে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সমাধান মিলবে। বিশেষ করে সংলাপের মধ্য দিয়ে অনেক সংকট কাটবে।

সংবিধান অনুযায়ী, চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। অর্থাৎ আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তার ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। চলতি সংসদের শেষ অধিবেশন ছিল গতকাল। শেষ কার্যদিবস ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভারও। আজ থেকে এই সরকারই পরিগণিত হবে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ না থাকায় মন্ত্রিসভার আকার ছোট বা বড় করার এখতিয়ার সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সে হিসেবে গতকাল ছিল নির্বাচনকালীন সরকারের আগের মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক। ওই বৈঠক থেকেই নির্বাচনী রাজনীতির জন্য বইতে শুরু করে স্বস্তির সুবাতাস।

গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এক বিশেষ বৈঠকে সংলাপের ব্যাপারে সম্মতি জানান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংলাপে সম্মত হন তিনি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই শর্তহীন এই সংলাপে বসবে আওয়ামী লীগ। স্বয়ং শেখ হাসিনা এই সংলাপে নেতৃত্ব দেবেন। দলের পক্ষ থেকে শিগগিরই ঐক্যফ্রন্টকে সংলাপের দিন, সময় ও স্থান জানিয়ে দেওয়া হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এর আগে গত রোববার শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে সব দলের অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ চেয়ে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে পৃথক চিঠি দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। সেই চিঠির বিষয়ে গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনা হয়। সেখানেই প্রধানমন্ত্রী সংলাপের বিষয়ে সাড়া দেন।

পরে সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সংলাপের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি জানান, মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের দেওয়া চিঠির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। অনির্ধারিত এই আলোচনা শেষে সর্বসম্মতি সিদ্ধান্ত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংলাপে বসবে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোনো শর্ত ছাড়াই হবে এই সংলাপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে দলের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন। শিগগির আলোচনার স্থান ও সময় জানানো হবে।’ তবে ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে কোনো চাপের মুখে এই সংলাপ হচ্ছে না এবং তারা কোনো পূর্বশর্তও দিচ্ছে না। আমরা কারো চাপের মুখে নতিস্বীকার করিনি। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কাউকে সংলাপে ডাকিওনি’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘তারা সংলাপ করতে চান, ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। সংলাপের দরজা সবার জন্য খোলা। শেখ হাসিনার দরজা কারো জন্য বন্ধ থাকে না।’

পরে রাতে ওবায়দুল কাদের ফোনে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুর সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে কথা বলেন। এ ব্যাপারে মোস্তফা মহসিন মন্টু জানান, ওবায়দুল কাদের ফোন করে সংলাপের জন্য গণভবনে নৈশভোজের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু সংলাপ কবে হবে তা ঠিক হয়নি। আজ বা আগামীকাল সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আজ সংলাপের সময়ের বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর কথা রয়েছে।

গণফোরামের এই নেতা আরো জানান, তার কাছে ফোন করে ওবায়দুল কাদের জানতে চেয়েছেন সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট থেকে কতজন অংশ নিতে পারে। এ বিষয়ে তিনি তাকে জানিয়েছেন, প্রায় ১৫ সদস্যের একটি দল অংশ নিতে পারে।

এর আগে অবশ্য সংলাপের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সংলাপের ঘোষণার খবর শুনে গতকাল বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের মতিঝিলের চেম্বারে বৈঠকে বসেন এই জোটের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা। পরে মওদুদ আহমদ বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।

অন্যদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিধান রেখে গতকাল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এর ফলে নির্বাচন কমিশন ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহার করতে পারবে। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সংসদ অধিবেশন গতকাল শেষ হওয়ায় এখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব আইনে পরিণত হবে। এর ফলে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার সমাধান মিলল।

একইভাবে নির্বাচনী ক্ষণগণনা শুরুর একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। গত রোববার এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। তবে তখন ইসি থেকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। পরে গত রোববার ইসি জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করে। এর ফলে এখন থেকে জামায়াতে ইসলামী দেশের একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিগণিত হবে এবং কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।

এখন অপেক্ষা শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের। এর আগে গতকালের মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু গতকাল এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভায় কোনো আলোচনার খবর পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার আকার কেমন হবেÑ এ নিয়ে নানা মত সরকারের ভেতর ও বাইরে। এত দিন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলে আসছিলেন, ২০১৩ সালের মতো এবারও ভোটের আগে ‘ছোট পরিসরের নির্বাচনকালীন’ মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। চলতি বছরের শুরুতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নিজেও তেমনই আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার ছোট নাও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বর্তমান সংবিধানে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না তবে তিন মাসের ক্ষণগণনা শুরু হলে সংসদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। সংবিধান অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। একইভাবে তফসিল ঘোষণার প্রায় ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা হিসাব করা হয়। সে হিসাবে এখন যেকোনো দিন মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ছোট আকারের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন অথবা এই মন্ত্রিসভা বহাল রাখতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। এ ব্যাপারে সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close