প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-বাদশাহ আজিজ বৈঠক

সৌদি উদ্যোক্তাদের প্রতি বিনিয়োগের আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থে সৌদি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে তার সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। গতকাল বুধবার সকালে বাদশাহ সৌদ রাজ প্রাসাদে দেশটির ব্যবসায়ীদের সংগঠন সৌদি চেম্বার এবং রিয়াদ চেম্বার অব কমার্স নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। আর দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরগায় রাজ প্রাসাদে সৌদি বাদশাহ এবং পবিত্র দুটি মসজিদের খাদেম সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে তারা দুদেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। পরে তারা মধ্যাহৃভোজে অংশ নেন।

বিকেলে রিয়াদে নিজস্ব জমিতে বাংলাদেশের দূতাবাস ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রিয়াদের কূটনৈতিক কোয়ার্টারে ৭ হাজার ৯৫০ বর্গমিটার আয়তনের ওই প্লটে নির্মিত দূতাবাস ভবনটি তিনি উদ্বোধন করেন। এত দিন রিয়াদে ভাড়াবাড়িতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাজ চলত। প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের জুনে সৌদি আরব সফরে গিয়ে নতুন দূতাবাস ভবনের ভিত্তি স্থাপন করেন। ওই বছর ২৫ আগস্ট চ্যান্সেরি কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৩ হাজার ৮১৮ দশমিক ৬৮ বর্গমিটার আয়তনের ওই দূতাবাস ভবনের সেবাপ্রত্যাশীদের অপেক্ষার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপরিসর অপেক্ষা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ব্যবসায়ী নেতাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি পারস্পরিক স্বার্থেই আপনাদের বাংলাদেশে ব্যবসা, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা যাতে আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় একে অপরের হাতে হাত রেখে চলতে পারি।’

শেখ হাসিনা সৌদি বাদশাহ এবং পবিত্র দুটি মসজিদের খাদেম সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আমন্ত্রণে চার দিনের সরকারি সফরে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সৌদি আরব যান। সৌদি চেম্বার এবং রিয়াদ চেম্বার অব কমার্স নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে সিএসসির চেয়ারম্যান সামি এ আলাবাদি, সিএসসির মহাসচিব সৌদ এ আলমাসারি এবং বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ এইচ এম আল-মুতাইরি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিডার চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল হক, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহও উপস্থিত ছিলেন।

শেখ হাসিনা সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সৌদি আরবে পৌঁছান। আগামীকাল শুক্রবার তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সৌদি উদ্যোক্তাদের দেশের বিভিন্ন উদীয়মান খাত যেমন পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিকমিউনিকেশন ও তথ্যপ্রযুক্তি, পেট্রোকেমিক্যাল, ওষুধশিল্প, জাহাজ নির্মাণ এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আমি আপনাদের হাল্কা প্রকৌশল শিল্প, ব্লু ইকোনমি, গবেষণা, উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, পানি ও সমুদ্রসম্পদ, অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোগত প্রকল্পে এবং সেবামূলক খাত যেমন ব্যাংকিং ও অর্থনীতি, লজিস্টিক ও মানবসম্পদ খাতেও বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাই।

এ সময় বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকা এবং আকর্ষণীয় প্রণোদনার সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে অধিকহারে মুনাফা নিয়ে দেশে ফেরার বিষয়টিও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। যার মধ্যে রয়েছে আইন দ্বারা সুরক্ষিত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), ট্যাক্স হলিডে, যন্ত্রাংশ আমদানিতে স্বল্পশুল্ক প্রদান, বিনাশুল্কে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সুযোগ, রেমিট্যান্স অন রয়্যালটি, শতভাগ ফরেন ইক্যুয়িটির নিশ্চয়তা এবং লাভ, পুঁজিসহ বিনা বাধায় চলে যাওয়ার সুবিধা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক বেতন-ভাতায় সহজে প্রশিক্ষণযোগ্য নিবেদিতপ্রাণ জনশক্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে স্বল্পব্যয় ও আমাদের বৃহৎ শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশ সুবিধা। যার মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউ), অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, জাপান এবং নিউজিল্যান্ডের বাজারে প্রবেশের সুবিধা।’

বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিকে আঞ্চলিক যোগাযোগ, বিদেশি বিনিয়োগ এবং গ্লোবাল আউট সোর্সিংয়ের একটি কেন্দ্রে পরিণত করেছে। দেশে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলো (ইপিজেড) শতভাগ রফতানিনির্ভর। সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকে টেকসই করার জন্যই সরকার এই শিল্পাঞ্চলগুলো গড়ে তুলেছে।

শেখ হাসিনা এই শিল্পাঞ্চলগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য দেশে প্রায় দুই ডজনেরও বেশি হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমরা সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ করেছি, যেগুলো বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব চাহিদা মোতাবেক তারা ব্যবহার করতে পারবেন।

দুটি দেশের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে এখন সৌদি বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫টি প্রকল্পে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। যার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে, কৃষিভিত্তিক শিল্প, খাদ্য এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক, চামড়া, পেট্রোকেমিক্যাল, প্রকৌশল এবং সেবা খাত।

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে তার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করেছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়া তার রূপকল্প-২০২১ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধিশালী হিসেবে দেশ গড়ে তোলার পথে প্রথম ভিত্তি।

ক্রয়সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আমাদের দারিদ্র্যসীমা ৪১ দশমিক ৫ ভাগ থেকে ২১ দশমিক ৮ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের অর্থনীতিও বিশ্বের ১০টি দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির একটি।

শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত ১০ বছরে ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। এ বছরও ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, তার সরকার উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৯ গুণ বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই দ্রুত রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক খাতে দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যার রফতানির পরিমাণ গত অর্থবছরে ছিল ৩০ দশমিক ৬৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম সবজি উৎপানকারী, চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদনকারী এবং তৃতীয় বৃহৎ মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ।

ওষুধশিল্পকে বাংলাদেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য খাত অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ওষুধের ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রায় ১২৫টি দেশের বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হচ্ছে। আমরা মধ্যম আকারের সমুদ্রগামী জাহাজ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি করছি। দেশের ৯০ শতাংশ জনগণ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তার সরকার পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এক কদম অগ্রসর হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close