প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১০ অক্টোবর, ২০১৮

আয়বৈষম্য কমার ক্ষেত্রে পিছিয়ে বাংলাদেশ

* বিশ্বে ১৫৭ দেশের মধ্যে অবস্থান ১৪৮তম * দক্ষিণ এশিয়ায় আট দেশের মধ্যে সপ্তম

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ হওয়ার ভালো খবরের মধ্যেই জানা গেল দেশে ধনী ও গরিবদের মধ্যে আয়-রোজগারের যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে তা কাম্য মাত্রায় কমেনি। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতির (কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইকুয়ালিটি-সিআরআই) সূচক তুলে ধরে বলছে, এ সূচকে বিশ্বের ১৫৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে লাগামহীন বৈষম্য কমাতে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলের আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

গতকাল মঙ্গলবার বৈশ্বিকভাবে অক্সফামের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। অক্সফামের সঙ্গে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল নামের এক প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদনে বৈষম্য কমাতে বিভিন্ন দেশের তৎপরতার দিকটিই মূলত প্রাধান্য পেয়েছে। এ তৎপরতায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, আর্থিকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা সিঙ্গাপুরের অবস্থান ১৪৯তম। আর ভারতের অবস্থান বাংলাদেশ থেকে মাত্র একধাপ এগিয়ে ১৪৭তম। অক্সফাম বলছে, ২০১৫ সালে ১৯৩টি দেশের সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে

বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেসব দেশের তৎপরতা কেমন, প্রতিবেদনে সে বিষয়ই তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান অক্সফামের এই প্রতিবেদনকে ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বৈষম্যের বিষয়টি এখনো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্বীকারোক্তির জায়গায় নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বরং প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানের দিকটিই প্রাধান্য পাচ্ছে।’

প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ হবে বলে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক এক পূর্বাভাস দিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে সাড়ে ৭ শতাংশ। ২ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। উচ্চ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিলেও বিশ্বব্যাংক তাদের পর্যবেক্ষণে সতর্ক করে দিয়ে বলে, প্রবৃদ্ধিকে সংখ্যা দিয়ে না দেখে গুণগত মান দিয়ে দেখা উচিত। প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে চার ধরনের চাপ আছে। এগুলো হলোÑ খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন, বিদেশি অর্থায়নের ঘাটতি, তারল্য সংকট এবং বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি। প্রবৃদ্ধির এই উচ্চহার নিয়ে সরকারি মহলে সন্তোষ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। গত এপ্রিলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেন, প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা ছড়াচ্ছে। অক্সফামের প্রতিবেদনে মোট তিনটি বিষয়ের নিরিখে সিআরআই সূচক তৈরি করেছে। এগুলো হলোÑ সামাজিক খাতে ব্যয়, করনীতি এবং শ্রমিকদের অধিকার ও মজুরি। এই তিন ক্ষেত্রের মধ্যে বাংলাদেশ সামাজিক খাতে ১৪৬ এবং শ্রমিকদের অধিকার ও মজুরিতে ১৪৮তম অবস্থানে আছে। করনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খানিকটা এগিয়ে অবস্থান ১০৩তম।

দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে সিআরআই সার্বিক সূচকে এগিয়ে আছে মালদ্বীপ। এরপরই আছে শ্রীলঙ্কা। সবচেয়ে পিছিয়ে ভুটান। এর ঠিক পরেই অর্থাৎ সপ্তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ভারতের অবস্থান ষষ্ঠ। আট দেশের মধ্যে সামাজিক খাত ও করনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান চার। তবে শ্রমিক অধিকার ও মজুরির ক্ষেত্রে অবস্থান একেবারে শেষে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলের মধ্যেই এক ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। মেগা প্রকল্প, সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ বাড়ানোর একটা তাড়না চোখে পড়ে। তবে সেই প্রবৃদ্ধি সমন্বিত নয়। যেনতেনভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোকেই বড় বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অক্সফামের প্রতিবেদনে সামাজিক খাতে ব্যয়কে যেভাবে বৈষম্য বৃদ্ধির একটি সূচক হিসেবে দেখা হয়েছে, তা যথার্থ নয় বলে মনে করেন হোসেন জিল্লুর। তিনি বলেন, ধরা যাক বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতার মতো সামাজিক খাতে ব্যয় বাড়ানো হলো। তবে তার পরও তা সমন্বিত উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। যদি বেকারের কর্মসংস্থান না হয়, কাজের ক্ষেত্র না বাড়ে, তবে তো সেই উন্নয়ন হবে না।

অক্সফামের প্রতিবেদন নিয়ে অবশ্য বেশ ক্ষুব্ধ অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘আসলে অক্সফামের কাজ করার সুযোগ কমে গেছে। তারা দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মানুষের জন্য তাদের কাজ করা উচিত। সেটা বাদ দিয়ে এখন স্টাডি করছে।’

অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেসব দেশে ঘটে, সেখানে প্রাথমিকভাবে বৈষম্য দেখা দেয়। এটা সব দেশেই ঘটে। সেই বৈষম্য নিয়ে আমরা সচেতন।’

প্রবৃদ্ধি নিয়ে হোসেন জিল্লুরের মতের সঙ্গেও একমত নন এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের ভাত-কাপড়-কাজের জন্য কাজ করছি। আর এসব নিশ্চিত করার ফলেই আয় বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি ঘটছে।’ অক্সফামও অবশ্য মনে করে, দেশে বিভিন্ন খাতে চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে। সংস্থার ভারপ্রাপ্ত বাংলাদেশীয় প্রধান এম বি আখতার বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন এবং সরকারের সহযোগিতা অবশ্যই আমরা স্বীকার করি। কিন্তু পাশাপাশি বাড়তে থাকা নানা চ্যালেঞ্জকেই আমরা তুলে ধরেছি।’ এম বি আখতার বলেন, ‘আমাদের উপাত্ত নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে তা দেখাতে প্রস্তুত আছি।’ সিআরআই সূচকে এগিয়ে থাকা প্রথম তিন দেশ হচ্ছে ডেনমার্ক, জার্মানি ও ফিনল্যান্ড।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close