প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্বনেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে চলুন

জাতিসংঘে নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তি সম্মেলনে ভাষণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব পরিস্থিতিতে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব নিশ্চিতে বিশ্ব নেতাদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্তি বিনষ্ট করে এমন দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে চলতে হবে। নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় গত সোমবার বিকেলে জাতিসংঘ সদর দফতরে নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তি সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে এই আহ্বান জানান তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী বিপ্লবী, রাজনৈতিক নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এই শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এর আগে সকালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়কমন্ত্রী জেরেমি হান্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় জেরেমি হান্ট বলেন, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে যুক্তরাজ্য। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরাও চাই আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে এবং সব রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নেবে।

এ ছাড়া জাতিসংঘের সদর দফতরে একই দিন ‘ইনভেস্টমেন্ট ফর এডুকেশন অব উইমেন অ্যান্ড গার্ল’ শীর্ষক আলোচনায় শেখ হাসিনা রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গা শিশুরা যাতে আগের মতো শিক্ষাসহ অন্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না থাকে, সে জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সহায়তা দিচ্ছে, সে জন্যও ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, আমি মিয়ানমারে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি, যেন এই শিশুরা সেখানে ফিরে যাওয়ার পর শিক্ষাসহ সব অধিকার পায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর উদ্যোগে আয়োজিত এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতে তিন প্রস্তাব দেন। এগুলো হচ্ছে-সংঘাত, জাতিগত নিধন এবং গণহত্যা থেকে পালিয়ে আসা শিশুদের মানসিক আঘাত লাঘবে এবং সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে নজর দেওয়া। শিশুরা সাধারণ স্কুলে খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যায় পড়তে পারে। তাই তাদের জন্য অনানুষ্ঠানিক এবং দৈনন্দিন জীবনের দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করা। আর তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, জাতিসত্তা এবং ভাষা অনুযায়ী, এই শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

পরে সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভ্যর্থনায় যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লোটে নিউইয়র্ক প্যালেস হোটেলে বিশ্ব নেতাদের সম্মানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই অভ্যর্থনার আয়োজন করেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকারী বিশ্ব নেতারা এই অভ্যর্থনায় অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সোমবার যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার্স অব কমার্সের উদ্যোগে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজনে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।

নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শান্তি এখনো অধরা, তাই সব পরিস্থিতিতে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানবাধিকার উন্নয়নে ও সুরক্ষার জন্য শান্তি ও অহিংসার সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। জাতিগত নির্মূলের শিকার রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে বর্ণবাদ এবং অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেক সমাজের মানুষ বৈষম্য, জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি, অত্যাচার, এমনকি জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে গণহত্যার শিকার হচ্ছে। এ সময় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি এ সংকট নিরসনে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রীর তিন প্রস্তাব হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন, নীতি ও আচরণ বন্ধ করতে হবে মিয়ানমারকে। রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করার প্রকৃত কারণ খুঁঁজে বের করতে হবে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশের আলোকে ন্যায় বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

প্রস্তাবগুলো তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে তাদের মূল ভূমিতে ফিরে যাক। রোহিঙ্গাদের সাহায্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসার প্রশংসাও করেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা এখনো সুরক্ষিত নয়। যার জন্য ম্যান্ডেলার মতো নেতারা লড়াই করেছিলেন। গোটা বিশ্বের বিশাল একটি অংশের মানুষ এখনো ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিগত নিপীড়নের শিকার ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বৈষম্য ও শোষণের হাত থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক এ সমস্যা মোকাবিলায় সন্ত্রাসীদের অর্থ ও অস্ত্রের সরবরাহ বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা বাড়াতে হবে, সহনশীলতাকে উৎসাহিত করতে হবে।

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়া বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবদানের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের বিভিন্ন অংশে শান্তির জন্য কাজ করছেন। দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ ও মানবাধিকার উন্নয়নের মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করে আসছি আমরা।

নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবদান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও আমাদেরকে নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং স্বাধীনতা দিয়েছেন।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, এই সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। তবে তারা চুক্তি অনুযায়ী কাজ করছে না।

শেখ হাসিনা বলেন, যদি আমরা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারি এবং তাদের দেশে ফেরার জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরবে। তবে তেমনটি ঘটছে না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নামে একটি দ্বীপে স্থানান্তরে সবার সহযোগিতা কামনা করেন। জেরেমি হান্ট অচিরেই বাংলাদেশ সফরে তার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গত রোববার নিউইয়র্কে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। এর আগে গত শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভিভিআইপি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে একদিন অবস্থানের পর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। শেখ হাসিনা নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে অবস্থান করছেন।

জাতিসংঘে এবারের সফরে ৫০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্যবসায়ীদের ২০০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলও তার সফরসঙ্গী হয়েছে।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা। একই দিন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি।

এই অধিবেশন চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি পুরস্কার গ্রহণ করবেন। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় তার গতিশীল ও দূরদর্শী নেতৃত্বের জন্য আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা ইন্টার প্রেস সার্ভিস (আইপিএস) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করবে। পাশাপাশি গ্লোবাল হোপ কোয়ালিশন তাকে ‘২০১৮ স্পেশাল রিকগনিশন ফর আউটস্ট্যান্ডিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ অক্টোবর সকালে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close