প্রতীক ইজাজ

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিদেশিদের সাড়া দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই

নির্বাচনী দাবি পূরণে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকা, ওয়াশিংটনে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস জি ওয়েলসসহ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে গত রোববার দেশে ফিরেছে বিএনপি প্রতিনিধি দল। সফরকালে সেখানকার কূটনীতিক, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গেও বসেছেন তারা। এসব বৈঠকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে জাতিসংঘকে মধ্যস্থতা করা এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর এখন থেকেই নজর রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। এমনকি মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক করতে ও এসব আলোচনা অব্যাহত রাখতে দলটি বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলেও খবর প্রকাশ করেছে পলিটিকো নামে একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যম। এছাড়া শিগগির দলের একটি প্রতিনিধি দলের ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ব্রাসেলসে যাওয়ার কথাও রয়েছে।

বিএনপি দাবি করেছে, সফরকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিএনপির বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন ও দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে মূল্যায়নের সুযোগ পেয়েছেন। একইসঙ্গে এসব সফর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বন্ধু দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনার একটি অংশ বলেও দাবি দলের।

বিএনপির এই সফর ও লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি দেশে ভালো চোখে দেখছে না কেউই। এ নিয়ে দলের ভেতর ও বাইরে এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে দলটি। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং কূটনৈতিক

ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিএনপির এই সফর ও নালিশের মধ্য দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে বলেও মনে করছেন। তাদের মতে, বিএনপির উচিত ছিল দেশেই রাজনৈতিকভাবে এসব সংকটের সমাধান করা। কারণ নির্বাচন সামনে রেখে মধ্যস্থতার বিষয়ে জাতিসংঘ ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বা বিদেশিদের সাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনো দেশের সরকার অনুরোধ জানালে জাতিসংঘসহ এসব সংস্থা বা দেশ কেবল তখনই মধ্যস্থতা করে থাকে। এটা জাতিসংঘের রাজনীতি বিভাগের কাজের অন্যতম পূর্বশর্ত।

বিশেষ করে বিএনপি যে স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে, এর মধ্য দিয়ে দেশকে ও দেশের রাজনীতিবিদসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ছোট করা হয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ওই লেভেলে বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের জন্য চরম অপমানজনক। এটি ভালো কোনো রাজনৈতিক চর্চা নয়। এ পরিস্থিতি রাজনীতিবিদদের জন্য যেমন সম্মানজনক নয়, তেমনি গণতন্ত্রের জন্যও সুখকর নয়।

এমনকি এখন পর্যন্ত বিদেশিদের হস্তক্ষেপে দেশে কখনোই কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়নি বলেও জানান তারা। তাদের মতে, নিজেদের মধ্যে বসে আলাপ আলোচনা করেই সবকিছুর সমাধান করতে হবে। বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়ে লাভ নেই। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। অবিশ্বাস তৈরি হবে।

বিএনপির এই সফরকে গুরুত্ব দিচ্ছে না দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, কূটনীতিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা খুব সাধারণ বিষয়। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু নেই। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বা নিয়মতান্ত্রিক কূটনৈতিক তৎপরতার প্রতি মন্ত্রণালয় স্বাভাবিক নিয়মেই নজর রাখে এবং রাখছে। বিএনপি মহাসচিব জাতিসংঘে কার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কী আলাপ হয়েছেÑ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খোঁজ রাখছে। বিশেষ করে বিএনপি যে লেভেলে আলোচনা করেছে, সেটির কোনোই গুরুত্ব নেই।

বিএনপির এই বৈঠকের ব্যাপক সমালোচনা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষমতায় আসতে দেশের জনগণের আস্থা হারিয়ে বিএনপি এখন জাতিসংঘে গিয়ে কান্নাকাটি করছে বলেও মন্তব্য করেন। তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে এমনও বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশিদের কোনো ধরনের চাপের কাছেই সরকার মাথানত করবে না। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন হবে।

একইভাবে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বিএনপি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘে নালিশ দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা আরেক দফায় নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরও প্রমাণ দিয়েছে। এই নেতা আরো বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের কথা ফলাও করে প্রচার করা হলেও বাস্তবে সেটা হয়নি। বিস্ময়করভাবে বিএনপি মহাসচিব জাতিসংঘের একজন ডেস্ক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করে দলটির রাজনৈতিক অসহায়ত্বের প্রমাণ দিয়েছেন। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় জাতিসংঘের ওই ধরনের কর্মকর্তার কোনো ক্ষমতা নেই।

পাশাপাশি বিএনপির এসব কূটনৈতিক তৎপরতার দিকে আওয়ামী লীগ তীক্ষè নজর রাখছে বলে জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা মনে করছেন, এই বৈঠক নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নির্বাচনের আগে বিএনপি ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন শক্তি জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে নানা তৎপরতা চালাবে, এটা তাদের বিবেচনায় আছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। এবারও বিশেষ দূত আনার বিষয়ে বিএনপির চেষ্টা থাকতে পারে। তবে চাপে ফেলে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারবে না। বরং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যে পরিস্থিতি ছিল, এখন তার চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৩তম অধিবেশনে যোগ দিতে ৬ দিনের সরকারি সফরে আগামী শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন। এ সময় তিনি বিএনপির বৈঠকের ব্যাপারে জাতিসংঘের কিছু জানার থাকলে তা অবহিত করবেন এবং সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন।

বিএনপি এই সফরের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে ছোট করেছে বলে মনে করছেন দেশের কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে দেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবীর বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিছু রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এটা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও নানা দ্বন্দ্বের কারণেই এমনটি হচ্ছে। আমাদের উচিত হবে দেশের অভ্যন্তরেই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এসব সংকটের সমাধান করে। জাতিসংঘ বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারস্থ হলে নিজেদের দেওলিয়াত্ব প্রমাণ হয়। এটা উচিতও নয়। যেসব দেশে এ ধরনের সংকট আছে, সেসব দেশে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা দূত পাঠায়। বাংলাদেশ যদি সেসব দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারে, সেটাই হবে সবচেয়ে সম্মানজনক।

এই কূটনৈতিক বিশ্লেষক আরো বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। এমন হতে পারে তারা উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা তৈরির জন্য আলোচনার প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু তাতেও তেমন কোনো সুবিধা হয় না। কারণ এর আগেও বিভিন্ন সময় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কোনো কাজে আসেনি। সুতরাং আমাদের উচিত হবে নিজেদের মধ্যে বসে সমাধান করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশিদের দ্বারস্থ হতে দেখি। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে দেনদরবার শুরু হয়। এই সংস্কৃতি দেশের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। গণতন্ত্রের জন্যও সুখকর নয়। বরং এসবের মধ্য দিয়ে ওই সব সংস্থা বা রাষ্ট্র আমাদের ছোট করে দেখে। সম্মান করতে চায় না। নির্বাচন বা রাজনীতির বাইরেও ছোট-খাটো বিষয়েও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। অথচ এসব সংস্থার এসব সংকট সমাধানের কোনো এখতিয়ার নেই। তাই আমাদের উচিত হবে বিদেশিদের কাছে ধরনা না দিয়ে দেশেই রাজনৈতিকভাবে সংকটের সমাধান করা।

অবশ্য বিদেশিদের হস্তক্ষেপে দেশে কখনোই কোনো রাজনৈতিক সংকট নিরসন হতে দেখা যায়নি বলে জানান বিশ্লেষকরা। এর আগেও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারি ও বিরোধী দলের সমঝোতার লক্ষ্যে কমওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকু, কমওয়েলথ মহাসচিব চিফের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালসহ আরো বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে এ দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কেউই সফল হননি। এরা সবাই দফায় দফায় বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে দেশের রাজনীতিকদেরই সংকট সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close