প্রতীক ইজাজ

  ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নির্বাচনকালীন সরকারে নজর সবার

বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। সে হিসাবে সংসদের ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ আগামী ২৯ অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে যেকোনো দিন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। সে হিসেবে আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যেই সরকারকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। ফলে এখনো নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে প্রায় দুই মাস সময় হাতে রয়েছে সরকারের। অথচ এরই মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। চলমান রাজনীতির প্রধান অনুষঙ্গই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিষয়টি।

বিশেষ করে ‘আগামী ২০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে’- গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এমন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এ আলোচনায় আরো গতি পায়। অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার কখন হবে, সাইজ কী হবে, আকারে কতটা ছোট হবে, মন্ত্রিসভায় কতজন থাকবে- তা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না।’ কিন্তু বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনায় মুখর এখন রাজনৈতিক অঙ্গন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এবং তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপি বা তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কোন প্রতিনিধি রাখা হবে কি না এবং এ ধরনের সরকার গঠনে সরকার শেষ পর্যন্ত বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা বা সংলাপে বসবে কি না- এ আলোচনা যেমন হচ্ছে; তেমনি এ সরকারের আকার কেমন হবে, কারা ঠাঁই পাচ্ছেন মন্ত্রিসভায়- জানতে আগ্রহী ক্ষমতাসীনরাও। বিশেষ করে কবে নাগাদ গঠন হতে পারে নির্বাচনকালীন সরকার- তাও জানতে চায় মানুষ।

ফলে নির্বাচনকালীন সরকার ঘিরে কয়েকটি বিষয় আলোচনায় আসছে। এর মধ্যে রয়েছে কবে গঠন হচ্ছে এ সরকার এবং এ সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভাবনা কি এবং সংবিধানে এ ব্যাপারে কি বলা আছে। এমনকি এই সরকার গঠনে বিএনপির দাবিগুলো কতটুকু সাংবিধানিক ও এসব দাবি পূরণে সরকারের ভূমিকা কি হবে- তাও জানতে চান সবাই।

সরকার গঠন কবে : সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন হতে হবে। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে;’। সে হিসেবে সংসদেও মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ আগামী ২৯ অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে যে কোনো দিন একাদশ

সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই সময়কে বিবেচনায় রেখে ৩০ অক্টোবরের মধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা জানান, তফসিল ঘোষণার প্রায় ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা হিসাব করা হয়। ৩০ অক্টোবর বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ছোট আকারের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। সে ক্ষেত্রে এর আগের দিন ২৯ অক্টোবরের মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে মন্ত্রিসভার সব সদস্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারেন। তার মধ্য থেকে কিছু পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বাকিদের নিয়ে ছোট পরিসরের মন্ত্রিসভা হবে।

কেমন হচ্ছে সরকার : সরকারের নীতি নির্ধারণী সূত্রমতে, সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা নির্বাচনকালীন সরকারে থাকবেন। সেখানে বিএনপিসহ যেসব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, সেসব দলের কোনো প্রতিনিধি থাকছেন না। আগেরবার নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ২৯ জন। মন্ত্রী মর্যাদায় উপদেষ্টা ছিলেন ১০ জন। এবারও একই সংখ্যক সদস্য থাকতে পারেন নির্বাচনকালীন সরকারে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আগামী মাসের শুরুতে নির্বাচনকালীন সরকারের আকার স্পষ্ট হবে। বর্তমান সিনিয়র মন্ত্রীদের প্রায় সবাইকে রাখার ব্যাপারে এক ধরনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার আকার যেহেতু ছোট রাখতে হবে, তাই বর্তমানে যারা আছেন তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বাদ দেওয়া হতে পারে। তা ছাড়া এ মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র ও অভিজ্ঞ নেতারাই থাকবেন বলে জানান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তাদের মতে, প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তার মিত্রদের সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবিলায় শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গড়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিশেষ করে এবার নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে রাখা এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত বলে মনে করছেন দলীয় নেতারা। তাদের মতে, সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সরকারে বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের লোকেরাই থাকবে। এর বাইরে কোনো দলের প্রতিনিধি রাখার সুযোগ নেই। গত নির্বাচনে বিএনপি সংসদে ছিল। এ কারণে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের বার বার আহ্বান করেছিলেন নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিএনপি তাতে সাড়া না দিয়ে উল্টো সাংবিধানিক ধারাকে প্রতিরোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। এখন বিএনপি সংসদে নেই। তাই তাদের নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাবেরও কার্যকারিতা নেই।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের আকার কেমন হবে এবং কবে গঠিত হবে সেই সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর বাইরে কেউ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, অক্টোবরে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে এবং সেই সরকারের আকার ছোট হবে।

কি আছে বিএনপির রূপরেখায় : মুখে নির্বাচনকালীন সরকার চাইলেও এখন পর্যন্ত কোনো রূপরেখা দেয়নি বিএনপি। তবে দলীয় সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ইতোমধ্যেই তিনটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এসব খসড়ায় নির্বাচনের সময় সরকার প্রধান কে থাকবেন, সরকারে কারা থাকবেন এ নিয়ে তিনটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনকালীন ওই সহায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তিন মাস। খসড়ায় দলের নীতি নির্ধারকরা জানিয়েছেন, নির্দলীয় সহায়ক সরকার সংবিধান সংশোধন করে গঠন করা সম্ভব। আবার সংবিধান সংশোধন না করেও নির্দলীয় সহায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাখা না রাখার পক্ষে দুই ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ না করার শর্তে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারেন বলে একটি পক্ষের মত। রাষ্ট্রপতির অধীনে মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন দল বিশেষ করে নিবন্ধিত দল থেকে টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রীদের নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। ‘সর্বদলীয়’ সরকারের আদলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে।

অন্যদিকে, তিন মাসের এই সহায়ক সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকবেন। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের বিষয়ে প্রস্তাব রয়েছে রূপেরখায়। এ ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ টেকনোক্রেট কোটায় স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকলে তখন রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের দিয়ে কাজ করাবেন। এ মন্ত্রিসভায় আওয়ামী সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরাও থাকতে পারেন।

সংবিধান কি বলে : নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানান, এ সরকারের বিষয়ে সংবিধানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকার বলে সংবিধানে কোনো সরকারও নেই। সংবিধানের ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনোকিছুই অযোগ্য করিবে না।’

সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর অর্থ হচ্ছে যিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সংসদ বহাল রেখে সরকারের রুটিনওয়ার্ক পরিচালনা এবং নির্বাচন কমিশনকে অবাধ নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করা। নির্বাচনকালীন সরকার কবে নাগাদ গঠিত হবে এটা নিয়েও কোনো বাধ্যবাধতা নেই। এটা পুরোটাই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি চাইলে মন্ত্রিসভা ছোট না করে বর্তমান মন্ত্রিসভা নিয়েও নির্বাচন করতে পারেন।

অন্যদিকে, নির্বাচনকালীন সরকার ও ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির দাবিগুলো অসংবিধানিক বলেও জানা গেছে। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে ও ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে- বর্তমান সংবিধানে সহায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কাঠামো নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ কী হবে, কারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন বা থাকবেন না- তা নির্ধারণের একমাত্র অধিকার প্রধানমন্ত্রীর। একইভাবে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মেয়াদ অবসানের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই বলেও জানিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচনের আগে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি করেছে, সংবিধানের এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close