শংকর চৌধুরী, খাগড়াছড়ি

  ১৯ আগস্ট, ২০১৮

ফের রক্তাক্ত পাহাড়

খাগড়াছড়িতে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ৮

প্রতিবাদে কাল আধাবেলা হরতাল

পার্বত্যাঞ্চলে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আদিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আবারও রক্তাক্ত হলো পাহাড়। এবার খাগড়াছড়িতে প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউপিডিএফ (প্রসীত খীসা) মূল দলের ৩ নেতাকর্মীসহ ৮ জন নিহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার সকালে শহরের স্বনির্ভর বাজারে দুর্বৃত্তদের প্রকাশ্য গুলিতে ৬ জন নিহত হন। পরে দুপুরে ওই ঘটনার প্রতিবাদে করা মিছিলে ছোড়া গুলিতে নিহত হন আরো একজন। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একজন।

নিহতরা হলেন, ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি তপন চাকমা, সহসভাপতি এলটন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা পলাশ চামকা, মহালছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী ও উত্তর খবং পুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা জীতায়ন চাকমা, একই গ্রামের কান্দারা চাকমার ছেলে রূপম চাকমা ও স্বনির্ভর বাজারের চা দোকানি বিধান চাকমা, শন কুমার চাকমা ও সমর বিকাশ চাকমা। ইউপিডিএফের বিক্ষোভ মিছিলে হামলার ঘটনায় আরো তিনজন আহত হয়েছে। এরা হলেন, সোনা রঞ্জন চাকমা, উর্মি চাকমা ও মিনু চাকমা।

এদিকে, এই ঘটনার প্রতিবাদে কাল সোমবার আধাবেলা হরতালের ডাক দিয়েছে ইউপিডিএফ সমর্থিত তিন সংগঠন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার দফতর সম্পাদত সমর চাকমা স্বাক্ষরিত প্রেস বিবৃতিতে এই আধা বেলা সড়ক অবরোধে ঘোষণা দেয়।

এ ছাড়া দুই দফা হামলার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কাল সোমবার আধাবেলা জেলায় শান্তিপূর্ণ সড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ২২ আগস্ট মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ উৎসব ও সরকারি ছুটির কথা বিবেচনা করে এই সংক্ষিপ্ত অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অবরোধের সময় এম্বুলেন্স, রোগী বহনকারী যান, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ-পানি ও ওষুধ সরবরাহকারী গাড়ি অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে এবং জেলার সব যানবাহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ঘটনার জন্য জেএসএসকে (এমএন লারমা) দায়ী করেছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি শাখার সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা। তবে এই ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বাকীর করেছে জেএসএস (এমএন লারমা)।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৮টায় স্বনির্ভর বাজার এলাকায় একদল অস্ত্রধারী অতর্কিত হামলা চালায়। হামলাকারীরা বাজারের প্রবেশমুখে প্রথমে গুলি চালায়। পরে বাজারে ইউপিডিএফ কার্যালয়ের সামনে পিসিপি সভাপতি তপন, এলটন ও পলাশ চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাজারের দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়।

নিহত স্বাস্থ্য সহকারী জীতায়ন চাকমার স্ত্রী প্রভাতি চাকমা জানান, শনিবার অফিস বন্ধ থাকায় বাজারে নাস্তা করতে আসেন। এ সময় দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যায়। তিনি অভিযোগ করেন, স্বনির্ভর বাজার এলাকায় এত নিরাপত্তা থাকার পরও প্রকাশ্যে কীভাবে একজনকে খুন করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়?

আরেক গুলিবিদ্ধ পথচারী সমর বিকাশ চাকমার স্ত্রী জানান, সকালে বাজার করতে যান। এ সময় দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলি ডান পায়ে লাগে। এ ছাড়া সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে আহত হন পিসিপি খাগড়াছড়ি সদর থানা শাখার সভাপতি সোহেল চাকমা, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের ছাত্র দ্বিতন চাকমা, বেলতলি পাড়ার বাসিন্দা ফরেস্টার ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি সদরের পশ্চিম নারাঙহিয়ে গ্রামের বাসিন্দা ও পদ্ম চাকমার ছেলে চিজি মনি চাকমা।

আহত সোহেল চাকমা, সমর বিকাশ চাকমা ও শখিধন চাকমার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়ে সদর হাসপাতালের চিকিৎসক (আরএমও) নয়নময় ত্রিপুরা বলেন, তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলির চিহ্ন রয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে সমর বিকাশ চাকমা পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

হত্যার ঘটনায় প্রতিপক্ষ জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করেছে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ‘ইউপিডিএফ’ (প্রসীত খীসা) খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সংগঠক উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর সভাপতি বিনয়ন চাকমা ও শ্রমজীবী ফ্রন্ট (ওয়ার্কার্স ফ্রন্ট) এর সভাপতি সচিব চাকমা সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে ‘সংস্কারবাদী জেএসএস (এমএন লারমা) ও নব্য মুখোশ বাহিনী (ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক) হামলা চালিয়ে পিসিপি-যুব ফোরামের নেতাসহ ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে ইউপিডিএফ এর কেন্দ্রীয় সংগঠক মাইকেল চাকমা মুঠোফোনে জানান, প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেছে। জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এই ঘটনা ঘটিয়েছে। মিঠুন চাকমাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে ঠিক একই কায়দায় দুর্বৃত্তরা এই হামলা করল।

তবে এই ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা নেই জানিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) এর কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত চাকমা জানান, জেএসএস (এমএন লারমা) কোনোভাবেই জড়িত না। এরা অহেতুক আমাদের দোষারোপ করছে।

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি সাহাদাত হোসেন টিটো জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর এলাকায় অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, এ নিয়ে চলতি বছরে খাগড়াছড়িতে প্রতিপক্ষের হাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ সমর্থিত ১২ নেতাকর্মীসহ ৩৩ জন নিহত হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close