প্রতীক ইজাজ

  ১৮ আগস্ট, ২০১৮

লক্ষণ দেখে সুস্থ পশু কেনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

কোরবানির জন্য দেশি পশু পর্যাপ্ত

এ বছর দেশে কোরবানির জন্য দেশি পশুর অভাব নেই। সরকারি হিসাবে, বর্তমানে দেশে এক কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। চাহিদা সর্বোচ্চ ১ কোটি ১০ লাখ। গত বছর কোরবানিতে জবাই হয়েছিল ১ কোটি চার লাখ ২২ হাজার পশু। চাহিদা অনুপাতে এবার বেশি রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার পশু। ধারণা করা হচ্ছে, সামনে নির্বাচন থাকায় এবার পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়তে পারে। সে হিসাবে ৫-১০ শতাংশ পশু বেশি জবাই হলেও কোরবানির জন্য দেশি গরুর বর্তমান সংখ্যা এবার যথেষ্ট। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়েও দেশি গরু মোটাতাজাকরণের সংখ্যাও অন্যবারের চেয়ে বেশি।

ফলে এবারও দেশি পশুতেই কোরবানির চাহিদা পূরণ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও কিছু গরু আসবে। তাই কোরবানির পশু নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। পশুর হাটে এবার পর্যাপ্ত গরু থাকবে। দামও সহনীয় হবে।

এমন আশ্বাস দিয়েছেন প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দও। তিনি বলেন, এবার দেশি গরুতেই কোরবানি সম্ভব। বাইরের গরুর ওপর নির্ভর করতে হবে না। দেশের খামারগুলোতে ও ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে বাড়িতেও দেশি গরু ছাগল কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ফলে দামের জন্য বিক্রেতাদের ভাবতে হবে না।

একইভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, নির্বাচনের সময় হওয়ায় এবার পশু কোরবানি কিছুটা বেশি হবে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের ধারণা, সেটা ৫ ভাগের বেশি হয় না। এবার যদি এর চেয়ে কিছুটা বেশিও হয়, তবু পশুর কোনো সংকট হবে না। দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক কোরবানি উপযোগী পশু রয়েছে।

এই কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ ও ১৭ সালে পশু কোরবানির হিসাব বিবেচনায় এবার সর্বোচ্চ হলে ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হবে। সেটা হলেও অতিরিক্ত থাকবে অনেক কোরবানি উপযোগী পশু।

তারপরও শঙ্কা কাটছে না দেশি খামারিদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতেও কোরবানির জন্য গরু মোটাতাজা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেই অন্তত এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের আড়াই লক্ষাধিক গরুকে মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে প্রায় আড়াই লাখ ষাঁড় গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর জানিয়েছে, মোটাতাজা গরুর মধ্যে রয়েছে পাবনা ব্রিড, অস্টেলিয়ান-ফ্রিজিয়ান ব্রিড, ইন্ডিয়ান হরিয়ানা ব্রিড, পাকিস্তানি সাহিয়াল ব্রিড, হেমাটোপিনসহ কিছু পরিচিত ব্র্যান্ড। এ ছাড়া রয়েছে স্থানীয় ব্রিডিং পদ্ধতির পশু; যা লোকাল ক্রস ব্রিড নামে পরিচিত।

খামারিরা জানান, এসব এলাকায় কোরবানিতে একটু বেশি দামের আশায় সারা বছর খামারিরা দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করেন। শেষ মুহূর্তে যদি ভারত ও মিয়ানমার থেকে বৈধ ও অবৈধপথে গরু আসা বেড়ে যায়, তা হলে তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। তাদের অভিযোগ, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন সীমান্ত পথে গরু আনছেন। আমাদের প্রতিনিধিরা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন সীমান্ত পথে ভারতীয় গরু আসার তথ্য জানিয়েছেন। এর মধ্যে রাজশাহীর পবা, মতিহার, গোদাগাড়ী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের অহেদপুর ও রঘুনাথপুর সীমান্তে সরকার অনুমোদিত বিট বা খাটাল দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন গরু আসছে। আবার অবৈধভাবে রাতের অন্ধকারেও গরু আনা হচ্ছে।

তবে আগের তুলনায় এসব সীমান্ত দিয়ে গরু আসার সংখ্যা অনেক কমেছে বলে সীমান্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে। দেশের প্রধান ছয়টি স্থলসীমান্ত বন্দর সূত্রে জানা গেছে, তিন বছর ধরে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। গতবারের তুলনায় এ বছর প্রতিবেশী এই দুই দেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার গরু-মহিষ কম এসেছে। দেশে চাহিদা কমে যাওয়ায় ও সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে গরু আসার পরিমাণ কমছে।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এবার গরু মোটাতাজাকরণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিলের আওতায় স্বল্প সুদের ঋণ এবং উন্নত জাতের গরুর জাত পেয়েছেন খামারিরা। বাজারে গরুর মাংসের চড়া দামের কারণে ক্ষুদ্র খামারিরা এবার কোরবানির ঈদে ভালো দামের আশায় ঋণ সুবিধা নিয়ে বেশি গরু লালন-পালন করেছেন। তাই হাতে পর্যাপ্ত গরু থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রাণী ও প্রাণিরোগ বিশেষজ্ঞরা দেশের বাইরে থেকে আসা গরু না কেনার এবং এসব পশু আনা বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এবার বাইরের পশুর দরকার নেই। তারপরও আসলে দেশে ৩০ লাখের বেশি পরিবার তাদের খামারে দেশি গরুসহ বিভিন্ন পশু কোরবানির জন্য হৃষ্টপুষ্ট করছে, তারা ক্ষতির মুখে পড়বে। দাম পাবে না। একইভাবে বাইরে থেকে আনা অধিকাংশ গরুই কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা। এসব গরু জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এমনকি এসব গরুকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমনভাবে মোটাতাজা করা হয় যে, কেনার পর শরীরে প্রয়োগ করা ক্ষতিকর ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এসব পশু যেকোনো সময় মারা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে গরু আসা কমেছে। এবারও তেমন আসছে না। কারণ কোরবানির সময় পশুর চাহিদা মেটাতে দেশেই খামারিদের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। বর্তমানে দেশে ৫ লাখের মতো খামার গড়ে উঠেছে।

ইতোমধ্যেই দেশের কোরবানির হাটগুলোতে গবাদিপশু আসতে শুরু করেছে। আজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজধানীর হাটগুলোতে পশু বেচাকেনা শুরু হবে। এবার অস্থায়ী ২৫টি কোরবানি পশুর হাট বসেছে। এসব পশুর হাটে ইতোমধ্যেই পশু আসা শুরু হয়েছে। দুই-একদিনের মধ্যেই জমে উঠবে এসব হাট। এসব হাট থেকে পশু কেনার ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রাণিরোগ বিশেষজ্ঞরা।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাণিরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আবু হাদী নুর আলী খান বলেন, অবৈধ ব্যবসায়ীরা গবাদি পশু মোটাতাজাকরণ কাজে ক্ষতিকর স্টেরয়েড আইটেমের ডেক্সামেথাসন গ্রুপের বিভিন্ন ইনজেকশন প্রয়োগ করে থাকে। এ ছাড়া ইউরিয়া খাওয়ানো হয়। মুখেও বিভিন্ন ধরনের উচ্চমাত্রার ভিটামিনের মিশ্রণ খাওয়ানো হয়। অথচ এ ক্ষতিকর স্টেরয়েড আগুনের তাপেও নষ্ট হয় না। যেসব গরুকে পাম ট্যাবলেট, ডেক্সামেথাসন ও স্টেরয়েড খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়, সেসব পশুর মাংস খেলে মানবদেহে ভয়ানক রোগব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কৃত্রিমভাবে মোটা করা এসব গরুকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যায়।

নিষিদ্ধ ওষুধে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা প্রাণী চেনার উপায় কীÑ জানতে চাইলে এই প্রাণিরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রাকৃতিকভাবে শক্তি-সামর্থ্যরে কোনো গরু যেমন তেজি ও গোয়ার প্রকৃতির হয়, কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুগুলো ঠিক উল্টোভাবে ধীর ও শান্ত হয়ে থাকে। শরীরে ও আচরণে কোনো তেজিভাবই দেখা যায় না। এসব গরু অসুস্থতার কারণে সব সময় নীরব থাকে। এসব গরু ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। খাবারও খেতে চায় না। এসব গরুর পেছনের দিকে ঊরুর পেশিবহুল জায়গায় আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তা উল্লেখযোগ্যভাবে দেবে যাবে। কারণ বাইরে থেকে মাংস মনে হলেও এখানে মাংসের সঙ্গে ব্যাপক পরিমাণে পানি থাকে।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোরবানির পশুর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রতিটি ছোট হাটে একটি এবং বড় হাটে দুটি করে এবং ঢাকার গাবতলী হাটে চারটি মেডিকেল টিম থাকবে। গত বছর সারা দেশে ২ হাজার ৩৬২টি কোরবানির হাটে ১ হাজার ১৯৩টি মেডিকেল টিম কাজ করে। গবাদিপশুর খামারগুলোতে ‘স্বাস্থ্যহানিকর রাসায়নিক দ্রব্যের’ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close