নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৯ আগস্ট, ২০১৮

মায়ের মতো সঙ্গী ছিল বলেই সংগ্রামে বাবা সফল

প্রধানমন্ত্রী

স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফলতার পেছনে শেখ ফজিলাতুননেসার অনবদ্য অবদান ছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মায়ের ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার ত্যাগের কথা স্মরণ করে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘মায়ের সময়োচিত সিদ্ধান্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। যেকোনো সংকটে আমার মায়ের সিদ্ধান্ত দেওয়ার অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল।’ গতকাল বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মায়ের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আব্বা মায়ের মতো একজন সঙ্গী পেয়েছিলেন বলেই সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন।’

শিক্ষা ও উন্নয়নসহ কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার বাঙালির স্বায়ত্তশাসন চেয়ে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ওই ছয় দফাই পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উত্থাপন করার পর তা বাস্তবায়নের দাবিতে ৭ জুন হরতালের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সেই হরতালে ছাত্র-জনতা সেদিন অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। ঢাকার তেজগাঁও ও নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের মিছিলে গুলি চলে, নিহত হন বেশ কয়েকজন। সেদিন সন্ধ্যায় কারফিউ দিয়ে হাজার হাজার বাঙালিকে গ্রেফতার করা হলেও ছয় দফার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সেই পথ ধরে ১৯৭১ সালে ৯ মাস যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে বিশ্বের মানচিত্রে।

ছয় দফা দেওয়ার পর তার পক্ষে জনমত তৈরিতে বঙ্গবন্ধু যেখানেই জনসভায় করেছেন, সেখানেই তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্তরীণ করে তার বিচার শুরু হয়। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের একপর্যায়ে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাকে পাকিস্তানে নিয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন আইয়ুব খান। কিন্তু ফজিলাতুননেছার জন্যই বঙ্গবন্ধু ওই বৈঠকে যেতে পারেননি।

সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য আব্বাকে প্যারোলে নিয়ে যাবে। আমাদের প্রায় সব নেতাই রাজি ছিলেন যে, না আব্বা প্যারোলে যান। কিন্তু আমার মা কখনোই এর সঙ্গে একমত ছিলেন না।’

মায়ের নির্দেশে বাবার সঙ্গে দেখা করার স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি ওখানে গিয়ে দেখি, আমাদের বড় বড় নেতারা সবাই কিন্তু ভেতরে। এনারা ভেতরে। কিন্তু আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি কিন্তু গেটের বাইরে দাঁড়ানো।’

সবার অন্তরালে বাবার কাছে মায়ের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আব্বা কথা বলতে বলতে যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন, দেখলেন আমি দাঁড়ানো, নিচু কাঠের গেট। ওখান থেকে উনি আমাকে আদর করার জন্য গলাটা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কোনো চিঠি-টিঠি দিস না, তোর মা কী বলেছে বল’। আমি শুধু বললাম, ‘মা এখনো প্যারোলে যেতে নিষেধ করেছে, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছে। উনি ইন্টারভিউয়ের জন্য সময় চেয়েছেন, সময় পেলে উনি আসবেন। মা নিষেধ করেছে যেতে, আপনি কিন্তু যাবেন না’।”

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণ কী চায়Ñ তা বোঝা, জনমত সৃষ্টি করার পেছনে তার মায়ের বিরাট অবদান ছিল। জীবনের সব আশা-আকাক্সক্ষা বিসর্জন দিয়ে, ভোগবিলাস বিসর্জন দিয়ে আমার বাবার পাশে থেকে এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন আমার মা। আমার বাবার পাশে থেকে যেভাবে তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা না করলে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম কি না।’

মায়ের বুদ্ধিমত্তার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৬ সালের মে মাসে আব্বাকে গ্রেফতার করার পর ৭ জুন একটা হরতাল দেওয়া হয়। সেই হরতালটাকে সংগঠিত করা, কার্যকর করাÑ এসব কাজ কিন্তু আমার মা করেছে।’

তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে ফজিলাতুননেছা কীভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করতে বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক করেছেন, তারও বর্ণনা দেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “তিনি বিভিন্ন সময়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা করতেন। আমাদের বাসা সব সময় ইন্টালিজেন্সের লোকরা ঘিরে রাখত। আমার মা আমাদের নিয়ে যেতেন ছোট ফুফুর বাড়িতে। আর আমাদের বলতেন, ‘তোমরা ওই জানালার কাছে দাঁড়ায়ে থাকো, দেখো কারা কারা আছে’। ছোট ফুফুর বাড়িতে গিয়ে মা কাপড় বদলাতেন, পায়ের স্যান্ডেল বদলাতেন এবং বোরকা পরে স্কুটার ডেকে ওখান থেকে বের হয়ে আজিমপুর কলোনিতে আমাদের কিছু সরকারি অফিসার, আমাদের কিছু আত্মীয় ছিলেন, তাদের বাড়িতে ছাত্রনেতাদের ডাকতেন। সেখানে আব্বার নির্দেশনাগুলো পৌঁছে দিতেন মা। সেসময় আইবি এখন বলে এসবি, তারা ধরতেই পারেনি। আমি তো বলব, আমার মা ছিলেন আসলে একজন গেরিলা। একেকটা বাড়িতে দেখা করে কীভাবে আন্দোলনটা গড়ে উঠবে, ৭ জুনের হরতালটা গড়ে তোলা; সব কাজ উনি গুছিয়ে গুছিয়ে করতেন।”

পরিবারের সবাইকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পরাজিত শক্তি, তাদের দোসর পাকিস্তানি বাহিনীর যারা দালাল, যারা স্বাধীনতা চায়নি, দেশে থেকেও যারা মোনাফেকি বেইমানি করেছে, তারাই তো ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটাল। আমার মাকেও ছাড়েনি।’

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মমিন বক্তব্য দেন। এতে মুখ্য আলোচক ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা; স্বাগত বক্তব্য দেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close