জুবায়ের চৌধুরী
চাকরি দেওয়ার নামে ভয়ংকর প্রতারণা
প্রতারক চক্র চালাতে গ্রুপ অব কোম্পানি গঠন!
টাকা হাতানোর অভিনব কৌশল ‘সিকিউরিটি মানি’
কোম্পানির নামে করপোরেট এলাকায় ‘হাইলি ডেকোরেটেড’ ও চোখ ধাঁধানো অফিস। দামি আসবাবপত্রে সাজানো-গোছানো অফিস স্টাফদের পোশাক-আশাক ভদ্রোচিত, চালচলনও মার্জিত। কথিত অফিসের চেয়ারম্যান-ব্যবস্থাপনা পরিচালকও চলাফেরা করতেন নতুন মডেলের চোখ ধাঁধানো সব গাড়িতে। অফিস খোলার পরপরই কথিত কোম্পানির কার্যক্রম ও পণ্যের প্রচারের জন্য অনলাইনে চালু করা হতো ওয়েবপেজ। এরপর ফেসবুক ও বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় লোভনীয় বেতনে চাকরির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। সব শেষে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ‘সিকিউরিটি মানি’ নেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা-ঢাকা দিত কথিত ওই কোম্পানির লোকজন।
চাকরি দেওয়ার নামে কত অভিনব কায়দায় যে প্রতারণা করা যায়, তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। গত ১১ জুলাই রাতে রাজধানীর রমনা থেকে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে একটি প্রতারক চক্রের মূলহোতাসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। প্রতারক চক্রের ওই ১৩ সদস্য সম্পর্কে এসব তথ্য জানিয়েছেন ভুক্তভোগী চাকরি প্রার্থী ও সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা।
ভুক্তভোগীরা জানান, জাতীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তারা আবেদন করেন। এরপর ওই কথিত কোম্পানির ডাকে চাকরি প্রত্যাশীরা তাদের অফিসে গিয়ে এর সাজসজ্জা, স্টাফ-এমডিদের বেশভূষা-চলাফেরা দেখে মুগ্ধ হন। সেই মুগ্ধতা থেকে কর্তৃপক্ষ চাকরি হওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়ার পর ‘সিকিউরিটি মানি’ চাইলে তা নিঃসন্দেহে দিতেন চাকরি প্রত্যাশীরা। সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ‘সানলাইট গ্রুপ অব কোম্পানি’ নামে প্রতারণা করে এই চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন গা-ঢাকা দিয়েছিল। পরে নতুন করে তারা প্রতারণার ছক তৈরি করে। এর জন্য রমনা এলাকায় ‘ম্যাক্স ভিশন গ্রুপ অব কোম্পানি’ নামে বিলাসবহুল আরো একটি অফিস খুলে বসে। এরপর যথারীতি জাতীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। সবশেষে ফের চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে ‘সিকিউরিটি মানি’র নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আগেই ধরা পড়ে চক্রটি।
সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা আরো জানান, চক্রের মূলহোতাদের একজন আদনান তালুকদার ওরফে আল আমিন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, ২০১২ সালে তিনি চাকরির জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে প্রতারিত হন। এরপর তিনি নিজেই প্রতারণার পথ বেছে নেন। প্রথমে চার-পাঁচজন মিলে বিভিন্ন গ্রুপ অব কোম্পানির নামে প্রতারণা শুরু করে। এ সময় খালেদ মাহমুদ ওরফে সবুজ মিয়া কোম্পানির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলে। আর খন্দকার আলমগীর হোসেন ওরফে মাসুম ও জহুরুল হক নামে আরো দুজন সংবাদপত্রে চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়। এরপর থেকে অন্য কাজের পাশাপাশি খালেদ মাহমুদ ওরফে সবুজ মিয়া ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা এবং খন্দকার আলমগীর হোসেন ওরফে মাসুম ও জহুরুল হক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার কাজ করত। এভাবেই তারা প্রতারণার জাল বিছিয়ে চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। চাকরি দেওয়ার নাম করে চক্রটি ছয় বছর ধরে এভাবে গ্রুপ অব কোম্পানি গঠন করে প্রতারণা করছিল।
সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানি, রেক্সন গ্রুপ অব কোম্পানি, ম্যাক্স ভিশন গ্রুপ অব কোম্পানি, ইস্টার্ন গ্রুপ অব কোম্পানি, কেয়া গ্রুপ অব কোম্পানি, নেক্সাস গ্রুপ অব কোম্পানির নামে শত শত মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
প্রতারণার শিকার গোপাল চন্দ্র দেবনাথ জানান, কথিত সানলাইট গ্রুপ অব কোম্পানিতে আমার জয়েনিং ছিল ১ মে। সেদিন আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ছিল। সেজন্য ওইদিন আমার অফিসে যাওয়া হয়নি। ২ মে শুক্রবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ওইদিন অফিস থেকে জানানো হয়, ৩ ও ৪ মে আমি চাইলে ছুটি নিতে পারি। পরে ৫ মে আমি অফিসে গিয়ে দেখি বন্ধ। ৬ মে গিয়েও দেখি অফিস বন্ধ। সেদিন প্রতারিত হয়েছেন- এমন আরো ১৭ জনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। একপর্যায়ে হিসাব করে দেখি, আমাদের ১৭ জনের কাছ থেকে মোট ৫২ লাখ ৪১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ১৭ জনই নয়, আরো অনেকে প্রতারিত হয়েছেন। জয়েনিং লেটার পাওয়ার পর ওই কথিত কোম্পানির ফ্যাক্টরি দেখতে চেয়েছিলাম। তবে তারা তা দেখার অনুমতি দেয়নি।
গোপাল চন্দ্র দেবনাথ আরো জানান, গত ১১ মার্চ আমি একটি জাতীয় দৈনিকে সানলাইট গ্রুপ অব কোম্পানির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখি। পরে ওই কথিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুকে তথ্য যাচাই-বাছাই করি। সেখানে সন্দেহ করার মতো কিছু পাইনি। তাই অনলাইনের মাধ্যমে ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) পদে আবেদন করি। গত ৮ এপ্রিল আমাকে ফোন করে ইন্টারভিউয়ের তারিখ জানানো হয়। সে অনুযায়ী ৯ এপ্রিল বিকেল ৪টার দিকে আমি ওই কথিত কোম্পানির অফিসে যাই। ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকা পাঁচজন আমার সঙ্গে কথা বলেন। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় ফোন করে আমাকে ডিএমডি পদে নির্বাচিত হওয়ার সংবাদ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘১০ এপ্রিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নেওয়ার জন্য আমাকে তারা আবার ডাকে। সেদিন তাদের অ্যাডমিন সেকশন থেকে বলা হয়, কোম্পানির পেনশন স্কিমের জন্য তিন লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি হিসেবে জমা দিতে হবে। এটা পাঁচ বছর পর দ্বিগুণ হবে। এ ছাড়া মাসে মাসে এই টাকার কিছু লাভের অংশও আমাকে দেওয়া হবে। এসব শুনে আমি শেষমেশ আমার কাছে থাকা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দিই। একইভাবে প্রতারিত হওয়ার কথা জানান আব্দুল মান্নান নামে অন্য এক ব্যক্তি। তাকে নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানানো হলে তিনি পাঁচ লাখ টাকা ‘সিকিউরিটি মানি’ জমা দেন।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, চক্রটি ২০১৩ সাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অফিস নিয়ে প্রতারণা করে আসছিল। তারা মূলত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের টার্গেট করে বিভিন্ন পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়। তিন-চার মাস পর পর তারা তাদের অফিস পরিবর্তন করত এবং গা-ঢাকা দিত। তিনি আরো বলেন, এসব প্রতারণার ঘটনায় পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। তবে এর আগেই এই চক্রের বিরুদ্ধে রমনা, পল্টন ও গুলশান থানায় সাতটি মামলা করা হয়। চক্রটির সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি মানি লন্ডারিং মামলাও হবে, যা প্রক্রিয়াধীন।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিনহাজুল ইসলাম বলেন, এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে চার-পাঁচজন প্রতারণার মূল পরিকল্পনা তৈরি করত। আর বাকিরা বিভিন্ন সময় প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন কাজ করত। এ প্রতারণার কাজে চক্রটিকে একজন অর্থ সরবরাহ করত, তবে সে প্রকাশ্যে আসত না। আমরাও তার সন্ধান পাইনি। তবে তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
"