ক্রীড়া ডেস্ক

  ০৮ জুলাই, ২০১৮

ল্যাটিন ফুটবলের শোকাচ্ছন্ন বিদায়

বিশ্বকাপের ইতিহাস ও সাফল্য যখন পর্যালোচনা করা হয় তখন নিঃসন্দেহে সবার ওপরে থাকে ব্রাজিলের নাম। কারণটা অহেতুক নয়। বিশ্বকাপের ২১টি আসরের মধ্যে প্রত্যেকবার অংশগ্রহণকারী একমাত্র দেশ ব্রাজিল। সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। আসরের সর্বোচ্চ ২২৯ গোলের রেকর্ডটিও তাদের দখলে। বিশ্বকাপে টানা তিনবার (১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০২) ফাইনালে খেলার কীর্তিটাও তাদের। বিশ্বকাপে রেকর্ড ১৪ বার শেষ আটে খেলেছে ব্রাজিল। কিন্তু এবারও তাদের অভিযান শেষ হলো এই শেষ আটেই। নেইমার-মার্সেলো-কুতিনহোরা পারলেন না সেলেকাওদের কাক্সিক্ষত ‘হেক্সা’ এনে দিতে।

রাশিয়া বিশ্বকাপটা যে ফেভারিটদের জন্য নয় তা আগেই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। আন্ডারডগদের দাপটে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, স্পেন, পর্তুগালের মতো দলগুলো কবেই ঘরে ফিরে গিয়েছে। শেষ আশা বলতে ছিল ব্রাজিল। বিশ্বকাপের আগেই যাদের ভাবা হচ্ছিল অন্যতম ফেভারিট হিসেবে। সেই ব্রাজিলও এবার পারল না ইউরোপিয়ানদের ভিড়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। শেষ ল্যাটিন দল হিসেবেও বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে তারা।

ব্রাজিল শেষ বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলেছে ২০০২ জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপে। এরপর প্রতিবার ‘হেক্সা’ জয়ের আশা জাগালেও ঘরে ফিরতে হয়েছে একরাশ হতাশা নিয়ে। এবারও টিটের অধীনে সেই অধরা স্বপ্নকে বাস্তবায়নে নেমেছিল সেলেকাওরা। কিন্তু বেলজিয়ামের বিপক্ষে লড়াই করার পরও ২-১ গোলে হেরে কবর দিতে হয়েছে সব স্বপ্নকে। ব্রাজিল মূলত হেরেছে ভাগ্যের কাছে। পুরো ম্যাচে ৫৮ শতাংশ বল দখল ও প্রতিপক্ষের জালে এই রেকর্ড ২৭টি শট নেওয়ার পরও গোল শোধ করতে পারেনি তারা। অন্যদিকে বেলজিয়াম শট নিয়েছে মাত্র ৯টি। আর তাতেই সফল রবার্তো মার্টিনেজের দল। ভাগ্য ছাড়া ব্রাজিলের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেলজিয়ামের গোলরক্ষক থিবু কোর্তোয়া। নেইমার-কুতিহনহোদের নেয়া শটগুলো অতিমানবীয়ভাবে ঠেকিয়েছেন এই চেলসি গোলররক্ষক।

পরশুর ম্যাচে একদিকে ছিল ব্রাজিলের সাম্বা ফুটবল আর অন্যদিকে বেলজিয়ামের প্রেসিং ফুটবলের মহড়া। কিন্তু জোগো বোনিতোরা এতদিন যে সাম্বা ছন্দের জন্য লড়াই করে এসেছে তা অসহায় হয়ে পড়ল রেড ডেভিলদের শারীরিক শক্তি ও আচম্বিৎ কাউন্টার অ্যাটাকের কাছে। ব্রাজিল পরশু তাদের সেই পুরনো সাম্বা ফুটবলের ফুল ফুটিয়েছে মাঠে। তবে খেলাটা গোলের। আর সেখানেই পরাস্ত হতে হয়েছে সেলেকাওদের।

নেইমার-কুতিনহো-পাওলিনহোদের প্রতিভা নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। ব্রাজিলের অধিকাংশ ফুটবলার খেলেন ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলোতে। যার কারণে হয়তো গৌরবের সাম্বা আজ ইতিহাস হতে চলেছে। আর তার জায়গায় ভর করছে ইউরোপবাহিত আক্রমণাত্মক ফুটবল দৃষ্টি। ল্যাটিন ফুটবলের ধ্বংসের পেছনে এটাও একটা কারণ। এক সময় যে ল্যাটিন দলগুলো ছন্দময় ফুটবল দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করত আজ সেই ফুটবলের রাজত্বটা দখল করে নিয়েছে ইউরোপিয়ানরা। ২০০২ বিশ্বকাপের পর প্রত্যেকবার শিরোপা উঠেছে ইউরোপিয়ানদের হাতে। একসময় ৯টি শিরোপা ঘরে তুলে এগিয়ে ছিল ল্যাটিনরা। কিন্তু সে জায়গায় এখন ১২তম বারের মতো শিরোপা জয়ের পথে ইউরোপের দেশগুলো। এবারের শিরোপাটাও যাচ্ছে তাদের ঘরে।

তবে কি ল্যাটিন ফুটবল তাদের ইতিহাসটা হারিয়ে ফেলেছে? ব্যাপারটা হয়তো এমনই। কারণ গত দুই দশক ধরে ল্যাটিন দেশের ক্লাবগুলো সাফল্যের বিচারে অনেক পিছিয়ে পড়েছে ইউরোপের ক্লাবগুলোর চেয়ে। ল্যাটিন ফুটবলাররা তারকা হওয়ার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, পিএসজি, জুভেন্টাসের মতো সেরা ক্লাবগুলোতে। অথচ একসময় পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালডো, রোনালদিনহোদের মতো বিশ্বসেরা তারকারা ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেছিল ল্যাটিন ক্লাবগুলোতে। কিন্তু এখন লিওনেল মেসিদের প্রারম্ভিক যাত্রাটায় শুরু হচ্ছে ইউরোপের ক্লাবে।

বেলজিয়াম ইউরোপের নতুন পরাশক্তি। ইউরোপের ককপিট নামেও পরিচিত তারা। সাফল্য ও মুখোমুখি সাক্ষাতে তাদের চেয়ে এগিয়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু ব্রাজিলিয়ানদের এই বিশ্বকাপে লড়াইটা কেবল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে করতে হয়নি, লড়তে হয়েছে চোটের সঙ্গেও। এই ম্যাচের আগেই চোটে পড়েছিলেন মার্সেলো, ডগলাস কস্তা, ডানিলোদের তারকারা। আর চোটের কারণে তো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণটাও অনিশ্চিত হতে বসেছিল দলের প্রধান অস্ত্র নেইমারের। তবে বেলজিয়ামের বিপক্ষে মাঠে ছিলেন সবাই। ছিলেন না কেবল মধ্যমাঠের শক্তি কাসেমিরো। তার অভাবটাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে ম্যাচে। কারণ মারউইন ফেলাইনি, কেভিন ডি ব্রুইনদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতোই ব্রাজিল দলে ছিলেন এই রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। কিন্তু দুই টানা হলুদ কার্ডের ফাঁদে আর মাঠে নামা হয়নি তার।

বেলজিয়াম কেবল প্রেসিং ফুটবলের প্রদর্শনী করেনি, তার সঙ্গে ছিল তাদের ভৌগোলিকভাবে পাওয়া শারীরিক ও মানসিক শক্তি। এই শক্তি দিয়েই তারা কামব্যাকের গল্প লিখেছিল জাপানের বিপক্ষে। ব্রাজিলকেও তারা বেঁধে দিল একই কৌশলে। তবে এবারের বিশ্বকাপটা বিতর্কিত হয়ে থাকবে ভিডিও অ্যাসিসট্যান্ট রেফারির (ভিএআর) কারণে। পরশুর ম্যাচটিও বিতর্কিত হয়ে থাকল এই প্রযুক্তির কারণে। ডি-বক্সের ভেতর ভিনসেন্ট কোম্পানি পায়ে গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে ট্যাকল করলেও পেনাল্টি পায়নি ব্রাজিল। তার জন্য সেলেকাওরা রেফারিকে দোষ দিতে পারেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি দোষ কি হয়তো তাদের ভাগ্যের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist