প্রতীক ইজাজ

  ২৫ জুন, ২০১৮

সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা

সুষ্ঠু নির্বাচনের সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত শনিবার দলের বর্ধিত সভায় দেওয়া বক্তৃতায় দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে মূলত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সরকারের সদিচ্ছার কথাই বললেন তিনি। সভায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচন যেন স্বচ্ছ হয়, কেউ যেন নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে না পারেন। জনগণের মন জয় করে তাদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে। এর মধ্য দিয়ে এ বার্তা নিয়ে নেতারা যেমন ফিরে গেছেন তৃণমূলে; তেমনি সব দলের অংশগ্রহণে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছাও জানতে পারল দেশের মানুষ। বিশেষ করে এই বার্তা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও সরকারের নির্বাচনী দিক নিদর্শেনা বলেও মনে করা হচ্ছে।

অবশ্য নির্বাচনী রাজনীতির শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় নির্বাচন যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, সে ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন দলের নেতাকর্মীদের। সর্বশেষ ২০১৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে প্রথম এমন বার্তা দেন তিনি। এরপর দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভায় এবং প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ ও জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও তিনি এই বার্তা বারবার উচ্চারণ করেন। এমনকি এই সতর্ক বার্তার মধ্য দিয়ে তিনি দলকে সেভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, দেশের জনগণ খুবই হিসাবি। কেউ দুর্নীতি করলে তারা তা ভুলে যায় না। মানুষের চোখ খুলে গেছে। সময় খুব বেশি নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দলের বর্ধিত সভায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাকে এভাবেই দেখছেন। তাদের মতে, এই বার্তা কেবল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্যই নয়; অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও। বিশেষ করে এই বার্তার মধ্য দিয়ে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে থাকা বিএনপিকে বার্তা দিতে চেয়েছে সরকার। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে খুলনা ও গাজীপুরসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সরকার একই মনোভাব দেখিয়ে আসছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের অভিমত, দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দিলেও সরকারপ্রধানের এমন বার্তা মূলত সবার জন্য। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দেশে নতুন করে নির্বাচনী আবহ তৈরি হবে; তেমনি নির্বাচনী প্রস্তুতিতে আঁটঘাঁট বেঁধে নামতে তাগাদা বোধ করবে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির পথ সুগম হবে। একইভাবে সব দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপও বাড়বে। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে সরকারের স্বচ্ছ সুষ্ঠু নির্বাচনের ইঙ্গিত মিলছে বলে মনে করছেন তারা।

এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, দলের বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী যে বক্তৃতা দিয়েছেন, তা অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা। দলের সর্বশেষ সম্মেলনেও তিনি এমন বার্তা দিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে সরকারের সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করার ইচ্ছে প্রতীয়মান হয়। তখনো তিনি বলেছিলেন আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। এখনো প্রধানমন্ত্রী মনে করেন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। ফলে নির্বাচনে জেতা সহজ হবে না। তীব্র লড়াই হবে। তাই তিনি দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে এমন কঠোর নির্দেশ দিলেন। নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ইঙ্গিত।

তবে এমন বার্তাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য শেষ কথা নয় বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কেবল বার্তা দিলেই হবে না। এমন বার্তার প্রেক্ষাপটও তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এমন বার্তায় আশাবাদী হতে হলে অবশ্যই নির্বাচনে সবাইকে অর্থাৎ সব দলকে সমসুযোগ দিতে হবে। নির্বাচনে সবাইকে নিতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ হতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে।

অবশ্য বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক মীজানুর রহমান। তিনি বলেন, নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কি করবে তা সংবিধানে বলা আছে। সেখানে কাজ করতে দিতে হবে। নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনার বা কর্মকর্তাদের নির্বাচনের আগে ও পরে ছয় মাসের মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সংশোধনী আনতে হবে। এই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সেটা সংবিধানেও বলা আছে। নির্বাচনকালীন সরকার হবে ‘স্মল’ ও নির্বাচন কমিশন হবে ‘বিগ’। সুতরাং, নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে কোনো সংকট নেই।

‘তবে সরকারকে নিজের স্বার্থেই নির্বাচনের সময় সংসদকে অকার্যকর (বিলুপ্ত নয়, ডি-ফাংশনাল) করতে হবে’- উল্লেখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, এবার অনেক সংসদ সদস্য মনোনয়ন পাবে না। নতুনরা আসবে। তখন যদি মনোনয়ন বঞ্চিত সংসদ সদস্য সংসদে বহাল থাকেন, তা হলে তিনি নানা ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারেন। সুতরাং, সরকারকে সংসদ অকার্যকর করতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই। সংসদ অকার্যকর করা মানে কিন্তু বিলুপ্ত নয়। রাষ্ট্রপতি চাইলে যেকোনো সময় সংসদ সদস্যদের ডাকতে পারেন। সংবিধানে এমন বিধান আছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী, এবার বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। এমনটাই বারবার বোঝাতে চাইছেন দলকে। এমনকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতিও সে আভাস দিচ্ছে। একইভাবে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলও বলছে দল শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকই হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের বার্তার ইঙ্গিত দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতিতেও।

আওয়ামী লীগ সূত্রমতে, সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা রয়েছে। সে লক্ষ্যে চলতি বছরের অক্টোবরেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে দল। বিশেষ করে দুর্নীতির সাজায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার কারণে দলটি স্মরণকালের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ সময় পার করছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গণসংযোগে মনোযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, দলের ঐক্য সংহতকরণ, সাংগঠনিক অবস্থা মজবুতকরণ এবং নির্বাচনকালীন সরকারের সময় দলের করণীয় নির্ধারণ করতেই বর্ধিত সভায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সভায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও উপদেষ্টা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে তৃণমূলে ফিরে গেছেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির সামনে এখন একটাই দাবি নির্বাচনকালীন সরকার। সেখানেও সরকার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় গঠিত সরকারের মতোই মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে ছোট আকারের সরকার নিয়ে নির্বাচন করা হবে। সেখানে বিএনপির প্রতিনিধি রাখার সুযোগ নেই। পাশাপাশি বিএনপির বিষয়ে কৌশলী ভূমিকায় থাকবে বলেও জানিয়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, বিএনপি নির্বাচনে এলে এক ধরনের, না এলে অন্য ধরনের কৌশল অবলম্বন করবে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিলে তা কিভাবে প্রতিহত করা হবে সে নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী অক্টোবরেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পরেই গঠন করা হবে নির্বাচনকালীন সরকার। গতবারের মতো এবারও নির্বাচনের আগে সরকারের পরিসর ছোট করা হবে। তখন মন্ত্রিসভা ছোট হবে। সেই সময় রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না সরকার।

একইভাবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আপাতত নির্বাচনের প্রস্তুতি রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে দলের নীতি নির্ধারণী সূত্রগুলো জানিয়েছে। দলীয় সূত্রমতে, নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটিকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত অনানুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে রেখেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি না মিললে নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না বলে স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্য একমত হন গত ১ জুনের বৈঠকে। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ তৈরি হলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে বিএনপি। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে দলের অধিকাংশ নেতা মত দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি এখনো নির্বাচনের পথেই আছে। দলে এ জন্য প্রস্তুতিও আছে। তবে সব কিছু নির্ভর করছে সরকারের মনোভাবের ওপর। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চাইলে সরকারকে অবশ্যই ছাড় দিতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist