বিশেষ প্রতিনিধি

  ২৪ জুন, ২০১৮

বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা

নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে

নির্দেশ ও সতর্কবার্তা - * নির্বাচন যেন স্বচ্ছ হয়, কেউ যেন নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে না পারেন * জনগণের মন জয় করে তাদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে * দলের বদনাম করলে নমিনেশন নয়

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ও ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের বর্ধিত সভায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে, যেনে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারে।’

আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এ বর্ধিত সভার আয়োজন করে। এ সময় দলের তৃণমূল নেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কে প্রার্থী সেটা বড় কথা নয়, নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে জনগণের কাছে যেতে হবে। নির্বাচনে আমরা যাকে প্রার্থী করব, নৌকা মার্কা দেব, তার পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হবে। এজন্য এখন থেকে জনগণের কাছে যেতে হবে। নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে হবে।’ শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ বর্ণনা করে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে মানুষের রায়কে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। এজন্য তিনি নির্বাচনে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি পরিহার করার তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘আমরা বদনাম নিতে চাই না, জনগণের মন জয় করেই কিন্তু ক্ষমতায় আসতে হবে। নির্বাচনে জনগণ ভোট দেবে। ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি করে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। নির্বাচন যেন স্বচ্ছ হয়, কেউ যেন নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে না পারেন। জনগণের মন জয় করে তাদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে।’

সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ ও জাতীয় কমিটির সদস্য, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, দেশের বিভিন্ন মহানগরের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সারা দেশের জেলা ও উপজেলা, পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সংবিধান অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। সেই হিসাবে, আগামী নির্বাচন হতে হবে ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগও তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার আশা দেখছে।

নির্বাচনে জয়ী হতে দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। এই কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে; নির্বাচন মানেই এটা চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা কিন্তু আমাদের একটানা তৃতীয়বার। এই তৃতীয়বারের নির্বাচনে সবাইকে কিন্তু এক হয়ে কাজ করতে হবে।’

নির্বাচনী প্রচারণায় জনগণের মাঝে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি দলের তৃণমূলের উদ্দেশে বলেন, ‘এত কাজ আমরা করেছি, যে উন্নয়ন আমরা করেছি, এত উন্নয়ন করার ফলে মানুষ যে নৌকায় ভোট দেবে না তা কিন্তু নয়। যদি না দেয়; তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনারা তৃণমূল; এটাই আমার কথা। আপনারা সঠিকভাবে মানুষের কাছে যেতে পারেননি, বলতে পারেননি, বোঝাতে পারেননি, সেবা করতে পারেননি।’

শেখ হাসিনা এমনও বলেন, ‘এত উন্নয়ন কবে হয়েছে, কোন সরকার করতে পেরেছে? তবে কেন অন্য দল ভোট পাবে? যারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত; সেই দল কেন ভোট পাবে, এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাই না।’

বর্ধিত সভায় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ও জোটবদ্ধ নির্বাচনী কৌশল নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করছি; অনেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রার্থী হয়ে গেছেন। তারা প্রার্থী হয়ে, বিএনপি কী সন্ত্রাস করল, দুর্নীতি করল, লুটপাট করল; সেটা বলে না। উল্টো তাদের বক্তব্যে আওয়ামী লীগের এমপির বিরুদ্ধে, সংগঠনের বিরুদ্ধে কথা চলে আসে। কিন্তু আমি এখানে একটা ঘোষণা দিতে চাই; প্রার্থী হওয়ার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু প্রার্থী হতে গিয়ে আমার দলকে বদনামে ফেলবে; কোনো মতেই এটা আমি মেনে নেব না। এটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। যে উন্নয়নের কাজগুলো করছি সেগুলো না বলে, সেগুলো ভুলিয়ে দিয়ে, কার বিরুদ্ধে কী দোষ আছে; সেটা খুঁজে জনগণের কাছে যারা বলবেন, তারা কখনো আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না, পরিষ্কার কথা। তারা কখনো আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না।’

একই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আমি এটাই বলব, যারা আমার দলের বিরুদ্ধ কথা বলবে, দলের বদনাম করবে; সে কী এটা বোঝে না যে, তার ভোটও নষ্ট হবে। সে তাহলে কোন মুখে ভোট চাইতে যাবে। পাঁচ বছর দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সে যদি দলের বদনাম করে, জনগণ তো তাকেও ভোট দেবে না।’

এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের জন্য নিজে কিভাবে দিনরাত কাজ করেন সে বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি নিজের কর্মব্যস্ত জীবনের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আপনারা বলেন, আমার কী আছে? কোনো বিয়ে-শাদিতে যাই না, কোনো উৎসবে যাই না। আমি সারা দিনরাত দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আজ ডিজটাল বাংলাদেশ। যে যখন বক্তৃতা দেন মোবাইল ধরলেই কিন্তু আমি শুনি। সব রেকর্ড হয়। সব ম্যাসেজ আমি পড়ি। কোনো ম্যাসেজ বাদ যায় না। এখনো আমার মোবাইল ফোনে মনে হয় দিনে ৪০০-৫০০ ম্যাসেজ আসে। আমি যখনই সময় পাই বসে বসে পড়ি আর সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আমি করি।

নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্ধিত সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সংসদ সদস্যদের জন্য বেশকিছু সতর্কবার্তাও দেন। তাদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যারা সংসদ সদস্য, তাদের আমি বলব, একটা কথা মনে রাখবেন জনগণ কিন্তু খুব হিসাবি। কে দুর্নীতি করল, জনগণ কিন্তু সেটা মাথায় রাখে। কাজ করতে গেলে টাকা নিলে, এরপর ভোট চাইতে গেলে বলবে, ‘টাকা দিয়ে কাজ নিসি, ভোট দেব কেন?’

নাগরিকদের বোকা না ভাবার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘জনগণের এখন কিন্তু চক্ষু খুলে গেছে। এখন ডিজিটাল যুগ। তারা এখন বিশ্বকে জানতে পারে। যারা সংসদ সদস্য, তাদের হাতে এখন খুব বেশি সময় নাই।’

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের ওপরও দলীয় মনোনয়ন নির্ভর করবে বলে স্মরণ করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আপনারা নমিনেশন পাবেন কি, পাবেন না; তা নির্ভর করে আপনার এলাকায় আপনারা কতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন আর কতটুকু তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের নেতাকর্মীদের কতটুকু মূল্যায়ন করেছেন; সেটাও কিন্তু আমি বিবেচনা করে দেখব।’

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজের পক্ষে জনসমর্থন বৃদ্ধিতে অন্য দলের নেতাকর্মীদের না ভেড়াতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এখন তো অনেকেই আসবে। আমি আরেকটা সার্ভে করে বের করছি; যেহেতু আমরা ক্ষমতায় বিভিন্ন দল থেকে অনেকেই ছুটে আসে দলে আসতে। আর গ্রুপ করার জন্য কোনো বাছ-বিচার নেই, যাকে পাচ্ছে তাকে নিয়ে নিজের শক্তি দেখাতে চায়। এরা আসে মধু খেতে, এরা আপনার সঙ্গে থাকতে আসে না। এরা আপনার সঙ্গে থাকতে আসে নাই, আপনার জন্য কাজ করতে আসে নাই। আর যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; ভাবে যে এখানে এলে মামলা থেকে বাঁচতে পারবে। আর, আসে কারা? যারা মনে করে ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে পারলেই তো পয়সা বানাতে পারব।’

মামলা থেকে রেহাই পেতেও অনেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেÑ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুরো বাংলাদেশে আমরা একটা সার্ভে করেছি। কাদের কাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে আর কারা আমার দলে আছে। সেই তালিকা কিন্তু আমার কাছে আছে। আমি বলব, কেউ যদি তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন, তাদের এখনই বিদায় করেন। কারণ তারা দুঃসময়ে থাকবে না।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনেও মহাজোট থাকার ঈঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘আমরা মহাজোট করেছি, নির্বাচনের স্বার্থে করেছি। আগামীতেও করব, আমরা বন্ধু হারাব না। সবাইকে নিয়েই থাকতে চাই। এজন্য যতটুকু আত্মত্যাগ করতে হবে তা করব। বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বটা এক্ষেত্রে বেশি।’

বিএনপির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা নাকি জুয়া খেলে অর্থ উপার্জন করে, সেই জুয়াড়ি, মাদকসেবী, এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তারা কেন ভোট পাবে? সেই দল কেন ভোট পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর তো আমি পাই না। যদি বিএনপি-জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী ক্ষমতায় আসে তাহলে এই দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে উন্নয়ন আমরা করেছি তা থেকে পিছিয়ে লুটপাট করে খাবে।’

শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের শুরুতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানী, প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় চার নেতা, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন এবং জাতির জনককে শ্রদ্ধা জানান। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর আগে সূর্যোদয়ের ক্ষণে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সারা দেশের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি শুরু হয়। শেখ হাসিনা সকালে ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist