হাসান ইমন
মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা
* ক্যানসার, অ্যাজমার মতো রোগে এক যুগে মারা গেছেন ৮৮৩ জন
মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে রাজধানীর বর্জ্য অপসারণের কাজ করায় গত এক দশকে সিটি করপোরেশনের ৮৮৩ জন তালিকাভুক্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মী মারা গেছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শুধু জীবিকার তাগিদে এ কাজ করতে গিয়ে ওই পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ক্যানসার, অ্যাজমা, হৃদরোগ, স্ট্রোক, বক্ষব্যাধিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে অবগত থাকলেও পরিস্থিতির উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এই পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সহজভাবে করার পর্যাপ্ত আধুনিক পরিচ্ছন্ন সরঞ্জাম দিতে ব্যর্থ হয়েছে দুই সিটি করপোরেশনই। এমনকি এই পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করার কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করা হয় না।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। ভয়াবহতা স্বীকার করে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছেন তারা। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মী রয়েছেন ৭ হাজার ৯৫৯ জন। এর মধ্যে ডিএসসিসির রয়েছে ৫ হাজার ২১৭ কর্মী। তাদের মধ্যে পুরুষ ২ হাজার ৯০৫ এবং নারী ২ হাজার ৩১১ জন। অন্যদিকে ডিএনসিসির সরাসরি তত্ত্বাবধানে বর্তমানে দুই হাজার ৭৪২ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে ৮০০ জন স্থায়ী এবং এক হাজার ৯৪২ জন মাস্টার রোল কর্মী। স্থায়ী পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা মাসিক ২২-২৩ হাজার টাকা বেতন পান। আর অস্থায়ী কর্মীরা দৈনিক ৪৭৫ টাকা হারে মাসিক ১৪ হাজার ২৫০ টাকা বেতন পান। এ ছাড়া এর বাইরে এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় কাজ করছেন আরো প্রায় ৪ হাজার কর্মী। এর বাইরেও প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন দ্রব্য কুড়ানোর বিনিময়ে কাজ করেন বেশ কিছু হতদরিদ্র মানুষ। বাসাবাড়ি থেকে ডাস্টবিন ও ডাস্টবিন থেকে মূল ভাগাড়ে আবর্জনা চলে যাচ্ছে এই মানুষগুলোর হাত হয়েই। নিবন্ধিতদের বেতন চলনসই হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় তা নগণ্য। আর অবশিষ্টদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এই কঠিন কাজে জড়িয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুকেই যেন আলিঙ্গন করছেন তারা।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ জানান, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, সেই ময়লা নিয়ে যাওয়া এবং ডাস্টবিন ও বাসাবাড়ির ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। এ ছাড়া স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার এবং ল্যান্ডফিলে ময়লা ওঠানো-নামানোর কাজ করতে হয়। এসব ময়লা ফেলতে সিটি করপোরেশন থেকে হ্যান্ডস গ্লাভস দেওয়া হয়, কিন্তু অনেকেই এটি ব্যবহার করে ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এ কারণে বেশির ভাগ পরিচ্ছন্নতা কর্মীই খালি হাত-পায়ে কাজ করেন। এতে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কর্মীরা। রোগব্যাধির কারণে অনেকেই লিভার ও ফুসফুসজনিত জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু অর্থাভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পেরে অকালেই প্রাণ হারাচ্ছে। এ ছাড়া, চর্ম ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন প্রতিনিয়ত।
তথ্যমতে, গত এক যুগে রাজধানীতে মারা গেছেন ৮৮৩ জন নিবন্ধিত পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এর মধ্যে ডিএনসিসির ৪৭২ জন ও ডিএসসিসির ৪১১ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। দুই সিটিতে ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রতি বছর ৫৩ থেকে ৭২ পর্যন্ত ওঠানামা করলেও ২০১৭ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮ জনে। তাদের মধ্যে অ্যাজমায় ২৭ শতাংশ, ক্যানসারে ২২, হৃদরোগে ১৮, স্ট্রোকে ৭ এবং বার্ধক্য ও দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা গেছেন ২৬ শতাংশ কর্মী। আর নিবন্ধনের বাইরে থাকা কর্মীদের ব্যাপারে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্যই নেই কারো কাছে ।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. শারমিন ইয়াসমিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য পরিষ্কার কাজে নিয়োজিত থাকলে ধীরে ধীরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অ্যাকজিমা, চুলকানিসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের নানা সমস্যাও হতে পারে।
তিনি পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের উদ্দেশে পরামর্শ দিয়ে বলেন, কাজ শুরু করার আগে তাদের গ্লাভস, মাস্ক এবং বুটজুতা ব্যবহার করতে হবে। কাজ শেষে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত-মুখ পরিষ্কার করতে হবে। তিনি আরো বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সাধারণত রাতে কাজ করেন। তাই একজনের প্রতি রাতে কাজ করা ঠিক হবে না। তাদের এক দিন অন্তর অন্তর কাজ করতে হবে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময় পর মেডিকেল চেকআপ করাতে হবে।
পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে সিটি করপোরেশন গুরুত্বসহকারে কাজ করছে বলে জানালেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। এ বিষয়ে ডিএনসিসির উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করছেন। তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে হাতের গ্লাভস, পায়ের বুটজুতা, মাস্কসহ কয়েকটি সরঞ্জাম দেওয়া হবে। এ ছাড়া তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ইবনে সিনা হাসপাতালের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে। সেখানে ৪০ শতাংশ টাকা কম খরছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নানা জটিল রোগের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসচেতন বিষয় নিয়ে তাদেরকে এর আগে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে এ বিষয়টা নিয়ে এখন ভাবার সময় হয়েছে। দেখি এটা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না।
এ ব্যাপারে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খোন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, নগরীর পরিচ্ছন্নতার কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য কর্মীদের ঝুঁকি ভাতার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। এ থেকে বাঁচতে তাদের গ্লাভস, বুট, ড্রেস এবং বৃষ্টির সময় রেইনকোর্ট দেওয়া হয়। তারা যাতে এগুলো ব্যবহার করে সেজন্য কড়াভাবে তদারকিও করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মহিলাদের প্রাকৃতিক কর্মসম্পাদনের জন্য আগে তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এখন দক্ষিণের ৫৭ ওয়ার্ডে একটি করে হাজিরা ঘর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব হাজিরা ঘরের প্রতিটিতে টয়লেট ব্যবস্থা রাখা হবে। ইতোমধ্যে নিউমার্কেট, আজিমপুরসহ কয়েকটি স্থানে এ ধরনের টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিটি থানা পুলিশের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে বলে তিনি জানান। মারা যাওয়া কর্মীদের এককালীন অনুদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছুদিন টাকা দেওয়া বন্ধ ছিল। তবে আবারও এটি চালু করা হচ্ছে। কোনো কর্মী মারা গেলে দাফন বাবদ সাত হাজার এবং অনুদান হিসেবে তার পরিবারকে আরো ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয় বলে তিনি জানান।
"