জুবায়ের চৌধুরী
ওমরা ভিসায় দেশ ছাড়ছেন শীর্ষ মাদক কারবারিরা
* ঢাকার মাদক সাম্রাজ্য ৪৫ জনের দখলে * র্যাবের টার্গেটে ১৫০ মাদক গডফাদার
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাদকের বিরুদ্ধে দেখানো হচ্ছে জিরো টলারেন্স। কিন্তু কীভাবে এ মাদক দেশজুড়ে তার থাবা বিস্তার করছে, কারা এটিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের আনা-কানাচে, কাদের মদদে চলছে এসবÑ তারও অনুসন্ধান চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র্যাব-পুলিশের আলাদা তালিকায় দেশের মাদক চোরাকারবারিদের নাম ওঠে এসেছে। সেসব তালিকা ধরেই অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত শনিবার রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের ক্ষমতাসীন দলের এক পৌর কাউন্সিলরও মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এতেই বুঝা যাচ্ছে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স মনোভাব। অভিযানের পর থেকে বেশিরভাগ শীর্ষ মাদক কারবারি আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের খুঁজে বের করতেও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর অনেক শীর্ষ মাদক কারবারিরা ওমরা ভিসায় দেশ ছাড়ছেন বলে জানা গেছে। বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওমরার নাম করে দেশের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিরা পালাচ্ছেন। তাদের সহায়তা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তবে এ কয়েক দিনে কতজন মাদক কারবারি পালিয়েছেন সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
দেশের মাদক কারবারিতে নেতাকর্মী ও পুলিশের প্রত্যক্ষ মদদ থাকায় বিব্রত ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ড। বিশেষ করে কক্সবাজারের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে ইয়াবা কারবারির শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিবেদন দিয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। আবার কক্সবাজারের সাইফুল করিম ইয়াবা কারবারিতে দেশের অন্যতম সিআইপিও (কমার্শিয়ালি ইম্পরট্যান্ট পারসন) হয়েছেন। তবে সচিবালয়ে গতকাল রোববার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, যত দিন মাদক থাকবে ততদিন অভিযান অব্যাহত থাকবে। কে জনপ্রতিনিধি, আর কে কী সেটা দেখা হবে না।
জানা গেছে, শুধু দেশের অভিজাত এলাকায় নয়, বস্তি থেকে ক্যাম্পাস সব খানেই স্টাডি সার্কেলের মতো গড়ে উঠেছে ‘ইয়াবা সার্কেল’। সবাই বুঁদ হয়ে আছে বর্ণহীন এই ধোঁয়ার জগতে। কিন্তু তাদের কাছে ধোঁয়ায় মাঝেই যেন রয়েছে এক স্বর্গীয় সুধা। সর্বনাশা ইয়াবা ট্যাবলেটটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ শিক্ষার্থী, বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, শিল্পী, মডেল, অভিনেতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, উচ্চবিত্ত শ্রেণির গ-ি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বস্তরে এবং সারা দেশে।
এদিকে দেশে চলমান বিশেষ অভিযানে একের পর এক মাদক কারবারি কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন। সারা দেশে বহু মাদক কারবারি গ্রেফতারও হয়েছেন। আবার তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার নাম জড়াচ্ছে। পুলিশের করা সর্বশেষ একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ঢাকার এমন ১১ জনের নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা ও বাকি আটজন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা।
এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে ১১ জনের মদদে রাজধানীতে চলছে ৪৫ জন মাদক কারবারির মাদক সাম্রাজ্য। পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে রয়েছে পুলিশ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতার নাম। ঢাকা মহানগর পুলিশের সবশেষ মাদক কারবারিদের তালিকা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য মিলেছে। পুলিশ বলছে, প্রমাণ পেলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। তবে অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, শুধু চুনোপুঁটিদের ধরে মাদকের থাবা থেকে মুক্তি মিলবে না।
এদিকে, সারা দেশে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী চিরুনি অভিযান। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মতে, অভিযানে ১ রমজান থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৭ হাজার জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের তালিকায় প্রতি রাতেই যোগ হচ্ছে ৮/১০ জন করে মাদক কারবারির নাম। গতকালও দেশের বিভিন্ন জেলায় নিহত হয়েছেন ১১ জন মাদক কারবারি। কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশের তালিকাভুক্ত ৪৫ মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের ১১ গডফাদারদের মধ্যে কেউ এসব অভিযানের আওতায় আসেনি এখনো।
তবে ডিএমপির সবশেষ মাদক বিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মিলেছে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশের ৩ কর্মকর্তা বনানী থানার এসআই আবু তাহের ভূঁইয়া, পল্লবী থানার এসআই বিল্লাল ও মাজেদ মাদক কারবারিদের মদদ দিচ্ছেন। গত ১৫ এপ্রিল বনানীর কড়াইল বস্তি থেকে ১৬ মাদক মামলার আসামি বাবা কাশেমকে আটক করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে বনানী থানার এসআই আবু তাহেরের বিরুদ্ধে। তবে এসআই তাহের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এসআই তাহের বলেন, ‘আমার থানারই কয়েকজন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে চাচ্ছে। আমি ভালো কাজ করেছি দেখে পুরস্কারও পেয়েছি। আমার কাছে সব কিছুরই ডকুমেন্ট আছে। অনেক সময় অনেক কিছু মুখস্থ থাকে না। এছাড়া কেউ ভালো কাজ করলে তার পেছনে অনেকেই নারাজ থাকে।’
ডিএমপির প্রতিবেদনে পুলিশ ছাড়াও ওয়ার্ড কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পল্টন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান পপি, ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল ওয়াদুদ নান্নুর, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার হাজী জামালের নাম।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন সবুজবাগের ওহাব কলোনির স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা জামান ওরফে বাবরী মোস্তফা, ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুল্লাহ আসাদ, কাঁঠালবাগান ইউনিট আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মিন্টুর নাম। এছাড়াও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জালালের বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ করা হয়েছে। এদের মোবাইল নম্বরে কল করে কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ বলছে, প্রমাণ সাপেক্ষে সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য জানান, যেসব সদস্য কেউ যদি এ ধরনের কোনো কাজ করে থাকেন তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়েছে। তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যখন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তখন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শীর্ষ মাদক কারবারি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে চলমান মাদক বিরোধী অভিযান কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যাবে বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
র্যাবের টার্গেটে ১৫০ মাদক গডফাদার : র্যাবের গোয়েন্দাদের করা তালিকায় সারা দেশে ৩ হাজার ৬০০ মাদক কারবারি নাম ওঠে এসেছে। কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে তাদের। এর মধ্যে ১৫০ জনকে শীর্ষ মাদক কারবারি বা গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে র্যাব। এ তালিকা নিয়েই সারা দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে এই এলিট ফোর্স। র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, এই ১৫০ জনকে কঠিন পরিণতির শিকার হতে হবে।
সারা দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব অভিযানের আগেই পুলিশ, র্যাব ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আলাদা তালিকা তৈরি করে। এসব তালিকা ধরেই চলছে অভিযান। গত ১৩ দিনে সারা দেশে র্যাব-পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ৮৩ মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগের নামেই ১০টির বেশি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব ও পুলিশ।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখা জানায়, সারা দেশে খুচরা ও পাইকারি মাদক কারবারিদের নিয়ে একটি তালিকা করা হয়। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৈরি করা তালিকায় ৩ হাজার ৬০০ মাদক কারবারির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। এই তালিকা একেবারে সংক্ষিপ্ত করে ফেলা হয় শীর্ষ মাদক কারবারিদের নাম ধরে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ১৫০ জনের নাম উঠে আসে। তাদের বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে র্যাব। এই তালিকায় বেশ কয়েকজন হোয়াইট কালার মাদক ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে। গত ১৩ দিনে র্যাবের হাতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকের নামই এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল।
এ বিষয়ে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের শুরু থেকেই সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগের কথা বলে আসছেন। র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের নির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেননি তারা। তবে র্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ধরন ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে এ অভিযান রোজার ঈদের আগ পর্যন্ত চালাতে চাচ্ছেন তারা। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে অভিযান বিষয়ক কৌশল ও সময় পরিবর্তন হতে পারে।
র্যাব জানায়, গত ৪ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত ৬৯৯টি অভিযান চালিয়েছে র্যাব। এতে ৭২৩ জন মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রায় শতাধিক মাদক কারবারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। এ কয়েক দিনে সোয়া ৩ কেজি হেরোইন, পৌনে ৮ লাখ ইয়াবা বড়ি, সাড়ে ৬ হাজার ফেনসিডিল, ৩৮৮ কেজি গাঁজাসহ দেশি-বিদেশি মদ জব্দ করা হয়েছে। জব্দ করা এসব মাদকের বাজার মূল্য প্রায় ৫৮ কোটি টাকা।
"