প্রতীক ইজাজ

  ২৮ মে, ২০১৮

প্রধানমন্ত্রীর পশ্চিমবঙ্গ সফর

সাংস্কৃতিক কূটনীতিতে অগ্রগতি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই দিনের পশ্চিমবঙ্গ সফরের মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক আরো স্পষ্ট হয়েছে। বেশ কিছু ইস্যু অমীমাংসিত থাকলেও পাশে থেকে পরস্পরকে সহযোগিতা ও সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সমস্যা সমাধানের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে দুই দেশই। এমনকি সবচেয়ে আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়েও অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করেছে দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ‘এ বিষয়ে এখনোই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাই না’ বলে মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি তিনি এ তথ্যও দিয়েছেন যে, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিসহ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে।

এই সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তাদের বক্তব্য ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন; তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কলকাতায় বঙ্গবন্ধু ভবন এবং গবেষণা কেন্দ্র তৈরির ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুনমাত্রা পাবে বলেও মনে করা হচ্ছে। এ দফায় শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন ও ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে আরো দুটি প্রতিষ্ঠান তৈরির মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশেষ করে বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সুসম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগেই বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে নিজেদের উন্নত দেশে উত্তরণ ঘটাতে শেখ হাসিনার স্বপ্ন বা দৃশ্যকল্প (ভিশন) বাস্তবায়নে ভারত তাকে পূর্ণ সমর্থন দেবে। নরেন্দ্র মোদির এমন ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরো খানিকটা অবস্থান দৃঢ় হলো আওয়ামী লীগের। এমনকি এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে কেন্দ্র করে সফরের আগে থেকেই আলোচনায় মুখর ছিল দেশ। বিশেষ করে তিস্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সফরে অগ্রগতি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সফরকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা অবশ্য এবারের সফরকে দুই দেশের কূটনৈতিক সাংস্কৃতিক সফর বলে মত দিয়েছেন। এ সফরের মধ্য দিয়ে দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সংস্কৃতি লাভবান হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়েও কিছু অগ্রগতি হয়েছে।

এ ব্যাপারে সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবীর প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এই সফর মূলত সাংস্কৃতিক বিষয়ে। প্রটোকলও সেভাবেই সাজানো ছিল। সুতরাং, অন্যান্য বিষয় আলোচনায় আসার কথা ছিল না। কোনো পক্ষ থেকেই আগেভাগেই কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদি ও মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নিশ্চয় সেখানে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলেছেন। বক্তৃতায়ও প্রধানমন্ত্রী তিস্তার বিষয়টি তুলেছেন। রোহিঙ্গা বিষয়েও বলেছেন।

‘এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতির আরো অগ্রগতি হয়েছে। কিছু ভালো উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বীকৃতি পেয়েছেন, সেটাও দেশেরই অর্জন। বিশেষ করে ভারত যে কূটনৈতিক শিষ্টাচার দেখিয়েছে, তাতে দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক উঠে এসেছে। উচ্চ পর্যায়ের যে বৈঠকগুলো হলো, সে বিষয়গুলো আমরা জানি না। তবে এটা ঠিক যে, দুই দেশের যে নৈকট্য, সম্পর্ক ও পারস্পরিক নির্ভরতাÑ তাতে আমাদের প্রত্যাশা তো কিছু থাকেই। আমরা সামগ্রিক স্বার্থের ক্ষেত্রে কাজের অগ্রগতি দেখতে চাই’- বলে মন্তব্য করেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর।

কূটনৈতিকভাবে এই সফর সফল বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এটি মূলত সাংস্কৃতিক সফর। সেখানে সফল। দুই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় হলো। উদ্দেশ্য সেটাই ছিল। এখানে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার বিষয়ে সমাধান করতে যাননি। আমরা সেটা আশাও করতে পারি না। এমন কোনো প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়নি।

এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতেরও স্বার্থ আছে। চীন ফ্যাক্টর। সুতরাং, ভারতের দিকটাও ভাবতে হবে। তা ছাড়া এখানে রাজনীতি নিয়ে যেসব আলোচনা হয়েছে, সেটা একান্তই রাজনৈতিক দলের। এটা রাষ্ট্রীয় সফর। এ ধরনের সফরকে দলীয়ভাবে দেখা হয় না; রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখা হয়। নরেন্দ্র মোদি বর্তমান সরকারকে যে আশ্বাস দিয়েছে, সেটা কোনো দলকে বলেনি, সরকারকে বলেছে। সুতরাং, এ সফর লক্ষ্যের দিক থেকে সফল।

তবে সফর নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কোনো প্রকার বিতর্কে জড়াননি। আগ বাড়িয়ে কথাও বলেননি কোনো নেতা। শনিবারই প্রথম এ নিয়ে কথা বলেন দলের সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের কলকাতা সফরে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তিস্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হলেও ঘটা করে তা বলার সময় আসেনি। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী এবার দিল্লি সফরে যাননি। তিনি গেছেন কলকাতায় বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করতে। কাজেই তিস্তার পানি বণ্টন এবার তার সফরের এজেন্ডা নয়। কিন্তু তারপরও এবারের সফরে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।

দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানাভাবে তিস্তা ও রোহিঙ্গাসহ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো তুলেছেন বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যে মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত সইয়ের ব্যাপারে মমতার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন শেখ হাসিনা। তবে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মমতা তিস্তা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাই না।’ বিশেষ করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো। বৈঠক শেষে মমতা সাংবাদিকদের বলেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। তাকে ডি.লিট ডিগ্রি দিতে পেরে আমরা গর্বিত। বৈঠক খুব ভালো হয়েছে। সব কিছু পজিটিভ (ইতিবাচক)Ñএটাই বলতে চাই। দুই দেশের অর্থাৎ দুই বাংলার মানুষজন যাতে সুখে থাকতে পারে সে বিষয়ে আলাপ হয়েছে।

মমতার সঙ্গে বৈঠকের আগেই বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশলে তিস্তার বিষয়টি তুলেছেন। বক্তব্যে তিস্তা ইস্যুর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে একত্রে চলতে চায় এবং এ লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যকার সব সমস্যার নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে আমাদের এখনো কিছু সমস্যা রয়েছে, যা আমি এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশের স্বার্থে উত্থাপন করতে চাই না। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি যে, বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা যায়।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিও বৈঠকে ঠিক কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে- তা জানা যায়নি। তবে বৈঠক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তিস্তা চুক্তিসহ সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিস্তা চুক্তিসহ বেশ কিছু বিষয় অনিষ্পন্ন আছে। আমরা চাই সেগুলো শিগগিরই সমাধান করতে।’ গওহর রিজভী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। চাপ দিয়েছেন। আশা করি, খুব তাড়াতাড়িই হবে। কিন্তু তারিখ দেওয়া (চুক্তি সইয়ের) খুবই অসম্ভব আপাতত।’

এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেচার (ডি.লিট)’ ডিগ্রি অর্জনও দেশের জন্য সম্মানের বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বলেছেন, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এবং গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য সম্মান জানানো হলো শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাও এ সম্মান ‘সমগ্র বাঙালি জাতিকে উৎসর্গ’ করার ঘোষণা দেন।

উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ভারতে দুই দিনের সরকারি সফর শেষে শনিবার রাতে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি শান্তিনিকেতনে সদ্য নির্মিত বাংলাদেশ ভবনের যৌথভাবে উদ্বোধন করেন এবং সেখানে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। পরে কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে গত শনিবার সন্ধ্যায় ৫০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist