জুবায়ের চৌধুরী

  ২৬ মে, ২০১৮

স্বর্ণ আমদানি নীতিমালায় সম্ভাবনা : আছে শঙ্কাও

* চোরাচালান বন্ধের আশাবাদ * বিপুল রাজস্ব আয়ের সুযোগ

এতদিন চোরাচালানের মাধ্যমে স্বর্ণ আসত বাংলাদেশে। গুরুত্বপূর্ণ এ খাত নিয়ন্ত্রণে এতদিন কোনো নীতিমালাও ছিল না। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে সরকার। নীতিমালাটি চূড়ান্ত হওয়ার পর স্বর্ণের বার আমদানি করা যাবে বৈধভাবেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন হলে অবৈধপথে স্বর্ণ চোরাচালান অনেকাংশে কমে আসবে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নীতিমালায় সরকার শুল্ক কত ধার্য করবে তার ওপরই নির্ভর করবে আমদানি করা স্বর্ণ বাজারে চলবে কি না। একই মার্কেটে স্বর্ণের দুইটা দাম হতে পারবে না। এর সঙ্গে অনেক কিছু নির্ভর করে। এ বিষয়গুলো সমন্বয় করা গেলে বাজারে সুফল আসবে। তা না হলে সম্ভাবনার নীতিমালায় শঙ্কা থেকেই যায়। স্বর্ণ চোরা চালান কমবে কি না তা নিয়েও আছে সংশয়। গত ২৩ মে স্বর্ণ আমদানি নীতিমালায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভার অর্থনীতি-বিষয়ক কমিটি। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, আগে কখনো এই দেশে স্বর্ণ আমদানি হয়নি। এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে স্বর্ণ আমদানি করা যাবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, অবৈধ স্বর্ণ আমদানি প্রতিরোধের পাশাপাশি দেশীয় বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য এই নীতিমালা করা হচ্ছে। আমদানি করা স্বর্ণবার থেকে অলংকার তৈরি ও মূল্য সংযোজনের পর আবার রফতানির সুযোগ থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ আর স্বর্ণের বার আনতে পারবেন না। তবে অলংকার আনতে পারবেন নির্দিষ্ট পরিমাণ।

এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসু জানিয়েছেন, কোনো অথরাইজড ডিলার যেকোনো ব্যাংক, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে ব্যাংক নিয়োগ দেবে এবং তাদের মাধ্যমে স্বর্ণবার আমদানি করা যাবে। অর্থাৎ যিনি স্বর্ণ ব্যবসা করেন তিনি স্বর্ণবার কেনার জন্য তাদের কাছে অর্ডার প্লেস করবেন। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে স্বর্ণবার আমদানি করে দেবেন। এর ফলে যেটি হবে কতটুকু স্বর্ণ বিদেশ থেকে আমদানি করা হলো বা কাদের কাছে বিক্রি করা হলো তার একটা হিসাব থাকবে।

তবে স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে কি পরিমাণে শুল্ক ধরা হচ্ছে সেটি পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেছেন, সরকার শুল্ক কত ধার্য করবে তার ওপরই নির্ভর করবে আমদানি করা স্বর্ণ বাজারে চলবে কি না। যেমন একটা মার্কেটে দুইটা গোল্ডের দাম থাকতে পারে না। কারণটা হলো এখানে একটা পাকা সোনার হোলসেল মার্কেট আছে। রিসাইকেল করা পুরনো আছে। কাস্টমারের কাছ থেকে ধরুন ১০ বছরের বা ৫০ বছরের পুরনো সোনা দোকানে আসছে নতুন ডিজাইন হচ্ছে। সেই সোনা থেকে যদি আমদানি করা সোনার দাম বেশি হয় তাহলে তো সেই সোনা কেউ কিনবে না।

তবে বাংলাদেশের বাজারে রয়ে যাওয়া পুরনো স্বর্ণ আর বিদেশ থেকে হ্যান্ড লাগেজে আনা জনপ্রতি অনুমোদিত মোটে ১০০ গ্রাম স্বর্ণ দিয়ে যে বাংলাদেশে স্বর্ণের চাহিদা পূরণ হয় না সেটি বোঝা যায়। বহু দিন ধরে অভিযোগ রয়েছে চোরাচালান হয়ে আসা স্বর্ণের দিয়েই বাংলাদেশে স্বর্ণকারদের ব্যবসা পরিচালিত হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে বিমানবন্দরে দেড় হাজার কেজিরও বেশি স্বর্ণ জব্দ হয়েছে। স্বর্ণ অবৈধ পথে আসে বলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেছেন, আমদানির নিয়ম কানুন কতটা জটিল তার ওপর নির্ভর করবে ব্যবসায়ীরা সঠিক পথে আমদানি করবেন কি না। নতুন নীতিমালার ফলে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও নিয়মতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থায় এই খাত পরিচালিত হবে। একদিক থেকে সরকার যে একেবারেই শুল্ক পাচ্ছিল না সেটা কিছুটা মোকাবিলা হবে। কিন্তু সরকার যদি তা থেকে সুবিধা নিতে চায় তাহলে এর সঙ্গে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে শুল্কের পরিমাণ বা রেগুলেটরি নিয়মকানুন যেন এমন না হয় যাতে ব্যবসায়ীরা সঠিক পথে আমদানি না করে অন্য পথে কিছু করল।

বাংলাদেশে দীর্ঘদন ধরে কাগজে-কলমে কোনো স্বর্ণ আমদানি হয়নি। কিন্তু দেশের হাজার হাজার স্বর্ণালংকারের দোকানে ব্যবসা চলছে ঠিকই। তাই এ খাতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। গত বছরের শেষের দিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় ওঠে আসে, বাংলাদেশে বছরে ৪০ মেট্রিক টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। যার প্রায় ৩৬ মেট্রিক টনই আমদানি করতে হয়। এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেশের মার্কেট থেকে পূরণ হচ্ছে। যার পুরোটাই অবৈধপথে আসা স্বর্ণ।

জানা গেছে, স্বর্ণ আমদানির নতুন এই নীতিমালার খসড়া তৈরিতে সার্বিক সহায়তা করেছে টিআইবি। নীতিমালা করে স্বর্ণ চোরাচালান ঠেকানো সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানকে বলেছেন, স্মাগলিং কতটা হবে সেটা এই নীতির ওপর নির্ভর করবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের যে প্রচলিত আইন আছে তার প্রয়োগ, যথাযথ কর্তৃপক্ষের সমন্বয় দরকার। কিন্তু কর্তৃপক্ষের মধ্যেও এক অংশের যোগসাজশ ছাড়া স্মাগলিং হয় না। এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সরকারের সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করলেই চোরাচালান বন্ধ করা যাবে বলে বিশ্বাস টিআইবির এই শীর্ষ কর্মকর্তার। বিশ্বের সবচাইতে বেশি স্বর্ণ ব্যবহারকারী দেশ হলো বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত। সেখানে স্বর্ণ চোরাচালানের গুরুত্বপূর্ণ রুট বলা হয় বাংলাদেশকে। নতুন নীতিতে অনুমোদিত ডিলারদের মাধ্যমে সোনা আমদানি হলে সেটি বন্ধ হবে কি না সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। বৈধপথে আমদানি করা স্বর্ণগুলো অবৈধ উপায়ে ভারতে পাচার হবে না, তার নিশ্চয়তা দেবে কে?

এদিকে, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও থেমে নেই স্বর্ণ চোরাচালান। প্রায় প্রতিদিনই বিমানবন্দরে স্বর্ণের ছোট বড় চালান জব্দ হচ্ছে। কোনো কোনো চালানে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার স্বর্ণও জব্দ হয়। তারপরও স্বর্ণের চালান আসছেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার চালান জব্দের পরও পাচারকারীরা কিভাবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে? চালান জব্দ হলেও নেপথ্যের হোতারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিছু বহনকারী ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে আবারও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত হচ্ছে তারা। মামলার দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ, সাক্ষীর অভাব, তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্বলতাসহ নানা কারণে অপরাধীদের শাস্তিও হচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধরেই বিমানের টয়লেটে স্বর্ণ, সিটের নিচে স্বর্ণের প্যাকেট, যাত্রীর জুতার ভেতরে স্বর্ণ, লাগেজে স্বর্ণ আবার কখনো বা যাত্রীর পেটের ভেতরে ও পায়ুপথেও পাওয়া গেছে চোরাচালানের স্বর্ণ।

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে ১২৫টি সোনার চালান আটকের ঘটনায় প্রায় ৭০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রহস্যজনক কারণে অর্ধশতাধিক মামলার তদন্ত থেমে গেছে। চোরাচালান চক্রটি এতটাই শক্তিশালী যে তাদের পাকড়াও করতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দারা। চোরাচালানে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশ বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী, কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, কয়েকটি প্রাইভেট এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য এবং সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তা এবং বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্তাব্যক্তিরা সরাসরি জড়িত। এর ফলে কোনো অবস্থাতেই স্বর্ণ পাচার বন্ধ হচ্ছে না। কিছুদিন পর পরই আটক হচ্ছে বড় সোনার চালান। আর আটক না হওয়ার চালানের সংখ্যা যে কি পরিমাণ তা অজানা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশ ও স্থলপথে সোনা চোরাচালান হয়ে আসছে বাংলাদেশে। তবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বসে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে গডফাদাররা। এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন মোহাম্মদ আলী, মাসুদ করিম, মিন্টু, হামীম ও দিনাজ। চোরাচালানে তারা প্রবাসীদের ব্যবহার করছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ৫০ হাজার ১৫৫ টাকা। তবে সিঙ্গাপুরে সমপরিমাণ স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি ৪০ হাজার ১০০ টাকা। একজন ব্যক্তি ব্যবহারের জন্য প্রায় সাড়ে ৮ ভরি (১০০ গ্রাম) পর্যন্ত স্বর্ণালংকার আনতে পারেন। আর সিঙ্গাপুর থেকে ১০০ গ্রাম স্বর্ণ যেকোনোভাবে বাংলাদেশে আনতে পারলেই প্রতি ১০০ গ্রামে কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকা লাভ হয়। আর একসঙ্গে পাঁচ থেকে ছয়টি স্বর্ণের বার আনতে পারলে লাভ সাত থেকে আটগুণ। তাই প্রবাসীদের টার্গেট করে তাদের হাতে স্বর্ণের বার ধরিয়ে দেন চোরাচালানকারীরা। বহনের পারিশ্রমিক হিসেবে কখনো ঢাকার বিমান টিকিট, কখনো ৩০ থেকে ৪০ হাজার নগদ টাকা দেওয়া হয়।

এবার সোনা আসবে বৈধপথেও : খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত ডিলার সোনার বার আমদানির সময় বন্ড সুবিধা গ্রহণ করে আমদানি করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে অনুমোদিত ডিলারকে আবশ্যিকভাবে আমদানি নীতি আদেশ এবং কাস্টমস আইনের বিধান অনুসারে বন্ড লাইসেন্স নিতে হবে। জানা গেছে, সরকার সোনার জন্য নিজস্ব মান প্রণয়ন করবে। সোনার মান যাচাই ও বিশুদ্ধ সোনার পরিমাণ যাচাই নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ল্যাব টেস্ট, ফায়ার টেস্ট বা হলমার্ক টেস্ট সুবিধাসহ পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করবে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে দেশের স্বর্ণ খাতসংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার করা হবে। এতে বার্ষিক চাহিদা, আমদানি, রফতানি, ক্রয়-বিক্রয়, দোকান সংখ্যা, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ, বাজেয়াপ্তকৃত সোনার পরিমাণ, নিলামে সোনা বিক্রির পরিসংখ্যান ইত্যাদি থাকবে। নীতিমালা অনুসারে, নিবন্ধিত বৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা স্বর্ণালংকার রফতানিকারক সনদ নিতে পারবে। বৈধভাবে স্বর্ণালংকার রফতানি উৎসাহিত করতে রফতানিকারকদের স্বর্ণালংকার তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনামূলক বিশেষ সহায়তা দেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist