প্রতীক ইজাজ

  ২৬ মে, ২০১৮

স্থানীয় নির্বাচনী প্রচারে মন্ত্রী-এমপিদের অংশগ্রহণ

বৈষম্য কমেছে : আ.লীগ বিএনপিতে অসন্তোষ

এখন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনী প্রচারণায় সংসদ সদস্যরাও অংশ নিতে পারবেন। এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিধিমালায় ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্যদের নাম উল্লেখ ছিল। এবারের সংশোধনীতে সেটি বাদ দেওয়ায় সংসদ সদস্যরা প্রচারণার এ সুযোগ পাচ্ছেন। এমন সংশোধনী এনে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আচরণ বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব গত বৃহস্পতিবার অনুমোদন দিয়েছে ইসি।

আইন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) পর এই সংশোধনীর গেজেট প্রকাশ হবে। তবে এই সংশোধনী গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রয়োগ না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ব্যাপারে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, এটা অনুমোদন করা হয়েছে। ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে, গাজীপুরে সংসদ সদস্যের এ সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা গাজীপুর এখন শিডিউলভুক্ত হয়ে আছে। বিদ্যমান বিধিমালায় তফসিল ঘোষণার পর থেকে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়া বা প্রবেশের সুযোগ নেই। তবে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হলে তিনি ভোট দিতে যেতে পারেন।

এর আগে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (অফিস অব প্রফিট) হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আচরণ বিধিমালা সংশোধন করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার পক্ষে নির্বাচনী আইন সংশোধন করা হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে মন্ত্রী-এমপিদের নাম উল্লেখ না করে সরকারি সুবিধাভোগীদের প্রচারের (সরকারি যানবাহন, প্রচারযন্ত্র বাদ দিয়ে) সুযোগ করে দিয়ে বিধির খসড়া তৈরি করে তৎকালীন কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন। মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারের সুযোগ দেওয়া না দেওয়া নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে কমিশন। শেষে ওই বছরের নভেম্বরে প্রণীত পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৫-এর ২২ নম্বর বিধিতে একইভাবে সংসদ সদস্যদের ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে আগের মতই তাদের নির্বাচনী প্রচার বা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। সেবার বর্তমান সরকার ওই নিষেধাজ্ঞার পক্ষেই ছিলেন।

এই সংশোধন নিয়ে ইতোমধ্যেই রাজনীতিতে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা শুরু হয়েছে। সংশোধনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। বিপক্ষে বিএনপি। বর্তমান আচরণবিধিতে সংসদ সদস্যদের প্রচারে নামার সুযোগ না থাকায় আওয়ামী লীগ এই আচরণবিধি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিল অনেক আগে থেকেই। ক্ষমতাসীনদের মতো, এর আগে নির্বাচন কমিশনের বিধিমালা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য বৈষম্যমূলক। সংশোধনের ফলে এখন বৈষম্য কিছুটা হলেও কমবে। তাদের সংসদ সদস্যরা সিটি নির্বাচনে প্রচারের সুযোগ না পেলেও বিএনপি সংসদে না থাকায় সে দলের নেতারা প্রচারে নামতে পারছে, এতে সবার সমান সুযোগ থাকছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি অন্য দেশেও সংসদ সদস্যদের স্থানীয় নির্বাচনে প্রচারের সুযোগ থাকার কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে এই সংশোধনের বিপক্ষে বিএনপি। দলের নেতাদের মতো, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় সবার জন্য সমান সুযোগ রইল না। নির্বাচনের মাঠ আরো অসমতল হলো।

একইভাবে সংশোধনীর পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলছেন নির্বাচনবিশ্লেষকরাও। একপক্ষের মতে, যখন এমপি-মন্ত্রীদের নির্বাচনী প্রচারণার বাইরে রাখার সংশোধনী আনা হয়েছিল, তখন নির্বাচন হতো নির্দলীয়ভাবে। সেখানে প্রতীকের কোনো ব্যবহার হতো না। ফলে দলীয় লোকজনের দলের নাম নিয়ে প্রচারে নামার দরকার ছিল না। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। এখন প্রার্থীর মনোনয়ন থেকে শুরু করে প্রচারণায় দলের নাম ও প্রতীক মূল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার কারণে ক্ষমতাসীন এমপি-মন্ত্রীরা দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নামতে পারছেন না। পক্ষান্তরে ক্ষমতায় না থাকার কারণে বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা (যারা একসময় এমপি-মন্ত্রী ছিল), এমনকি স্বয়ং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও প্রচারণায় যেতে পারছেন। এর ফলে ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ পাচ্ছেন না।

আবার ইসির এই সিদ্ধান্তের ফলে আসন্ন সিটি নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির সুযোগ থাকবে না বলে আশঙ্কা অন্যপক্ষের। তাদের মতে, নতুন এই সিদ্ধান্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিবন্ধক হবে। এর ফলে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে না। সংসদ সদস্যদের প্রচারণার সুযোগ দেওয়ায় ক্ষমতাসীনরাই বেশি সুযোগ পাবেন। এ নিয়ে রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হবে।

অবশ্য ইসির দাবি, সবাইকে ‘সমান সুযোগ’ দিতেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ ব্যাপারে ইসি সচিব বলেন, সংসদ সদস্যপদ লাভজনক পদ না হওয়ায় তাদের ওপর থেকে এই বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হচ্ছে। কারণ সংসদ সদস্যরা কোনো অফিস হোল্ড করেন না, সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন না, কিনে ব্যবহার করেন। তাদের সঙ্গে কোনো সরকারি কর্মকর্তা যুক্ত নেই। প্রচারণায় অংশ নিতে পারলেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা তারা গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা ভোটের সময় ডাকবাংলো ব্যবহারের সুযোগ পাবে না।

আওয়ামী লীগ অনেক আগে থেকেই সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমপিদের প্রচারণা ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ রেখে আচরণবিধি পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছিল। এর আগে গত ১২ এপ্রিল ইসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবি জানান দলের নেতারা। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা, চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক এবং দলের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীরা নির্বাচনী প্রচারণায় স্থানীয়, জাতীয় কিংবা প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সেখানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এমনকি যে এলাকায় নির্বাচন হচ্ছে, সেই এলাকায় তিনি ভোটার হওয়া সত্ত্বেও ওই এলাকার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এটিই ছিল নির্বাচন কমিশনের ইতিপূর্বেকার আচরণবিধি। সুতরাং এই আচরণবিধির ব্যাপারে আমাদের আপত্তি ছিল এবং এই আচরণবিধিটা বৈষম্যমূলক ছিল। এখন সেই বৈষম্যটা কিছুটা কাটবে; কিন্তু পুরোপুরি কাটবে না।

এই নেতা আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপিকে অনেক সুবিধা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনো সংসদ সদস্য যেতে পারেন না। আওয়ামী লীগের কোনো মন্ত্রী যেতে পারে না। বিএনপির সাবেক মন্ত্রীরা যেতে পারে এমনকি খালেদা জিয়াও যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। এটি বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব।

কিন্তু বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এটা আইন এবং সংবিধানের পরিপন্থী। সরকার নির্বাচনকে নিজেদের মনের মতো করার জন্য অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন না করার তাদের যে অভিপ্রায়, তারই বহিঃপ্রকাশ এই সংশোধনী। তারা (সরকার) নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চায় না।

এই সংশোধনী নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন নির্বাচনবিশ্লেষকরাও। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিÑ দুই দলেরই যুক্তি আছে। পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগের বড় নেতারা এলাকায় যেতে পারছেন না। প্রচারণায় প্রার্থী ও দলের পক্ষে নামতে পারছেন না। এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। আবার ক্ষমতাসীন নেতারা নির্বাচনে প্রভাব খাটায় কি না, বিএনপির সেই ভয়। তবে মূল কথা হলো ব্যক্তি। যে ব্যক্তি প্রচারণায় নামছেন, ভোটাররা তাকে কীভাবে গ্রহণ করছে, তার ওপর নির্ভর করবে ভোট ও সমর্থন। জনগণ ভোট দেবে নিজের সিদ্ধান্তে। কেউ কাউকে জোর করতে পারবে না। সুতরাং এসব সংশোধনী খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো ইসির সদিচ্ছা। ইসি যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে, সেজন্য ইসিকে সব পক্ষের সহযোগিতা করতে হবে। এসব সংশোধনী কোনো সংকট না।

কিন্তু সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের মতে, এটাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বিঘœ হলো। এর মাধ্যমে জটিলতা বাড়বে, ইসির কন্ট্রোল আরো শিথিল হবে। অভিযোগ, বাদানুবাদ বাড়বে বহুগুণে। সার্বিক পরিস্থিতি হ্যান্ডল করা মুশকিল হয়ে যাবে; ইসির ভাবমূর্তিও সংকটে পড়বে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist