কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রামে হঠাৎ বেড়ে গেছে খুনখারাবি
এক মাস ধরে পুলিশ কমিশনার নেই, ৪ মাসে ২১ খুন
চট্টগ্রামে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে খুন-খারাবি। গত চার মাসে ২১টি খুন এবং লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। বেড়েছে চুরি, ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনাও। আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে উদ্বিগ্ন মানুষ। তবে পুলিশ বলছে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, শঙ্কার কিছু নেই। চট্টগ্রামে গত এক মাস ধরে পুলিশ কমিশনার নেই। পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার বিপিএম চট্টগ্রাম থেকে বদলি হওয়ার পর এখনো কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ভারপ্রাপ্ত দিয়ে কাজ চলছে। ফলে পুলিশ কমিশনার বিহীন চট্টগ্রামে অপরাধ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগের পুলিশ কমিশনার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা জোরদারসহ নানা কর্মকান্ডের ফলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা ছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে টিনএজ সন্ত্রাসীরা। বেড়ে গেছে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য। পুলিশের কাছে সন্ত্রাসীদের যে তালিকা আছে তাতে টিনএজ সন্ত্রাসীদের তেমন নাম নেই। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এখন যে যার মতো করে টিনএজ সন্ত্রাসী লালন করেন। নেতাদের কাছে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও অসহায়। অপরাধের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসী ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজে লিপ্ত হয়। ওয়ার্ড বা এলাকাভিত্তিক এসব সন্ত্রাসী কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এ নিয়ে সংশয়ে রয়েছে প্রশাসন। সন্ত্রাসের তালিকায় নতুন নতুন মুখ উঠে আসছে বলে তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, জানুয়ারি মাসে ৫টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪টি, মার্চ মাসে ৫টি ও এপ্রিল মাসে ৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জানুয়ারি মাসে ৮টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪টি, মার্চ মাসে ১৮টি ও এপ্রিল মাসে ১৩টি মামলা দায়ের হয়েছে চট্টগ্রাম নগরের ১৬টি থানায়। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও থামানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম নগরের ১৬ থানায় জানুয়ারি মাসে ২১টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯টি, মার্চ মাসে ২৯টি ও এপ্রিল মাসে ৩৭টি মামলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে।
গত সোমবার রাতে চান্দগাঁও থানার কামাল বাজার এলাকায় ১৮ বছর বয়সের আরাফাতকে গলায় ছুরি চালিয়ে রাস্তায় ফেলে যায় খুনিরা। তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আরাফাতকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ জানিয়েছে ওই এলাকার পপুলার জিমের এক নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে বিরোধের জেরে আরাফাত খুন হন বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছেন তারা। এর আগে ১৮ মে রাতে হাটহাজারী উপজেলার কাটিরহাট গ্রামে আফসানা পারভিন নামের এক তরুণীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক বিরোধের জেরে চাচাতো ভাই খোরশেদ আলম ও ভাবি নাসরিন আক্তার মিলে আফসানাকে ছুরিকাঘাত করেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এ ঘটনায় নাসরিন গ্রেফতার হলেও পলাতক রয়েছে খোরশেদ।
এ ছাড়া ১৮ মে সন্ধ্যায় সীতাকুন্ডের ত্রিপুরা পল্লীতে সুকলতি ত্রিপুরা (১৬) ও ছবি রানী ত্রিপুরা (১৩) নামের ওই দুই বান্ধবীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় এক যুবককে গ্রেফতারের পর পুলিশ বলেছে, আবুল হোসেন (২৫) নামের এই যুবক প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সহযোগীদের নিয়ে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
এর আগে গত ৫ মে রাতে বাঁশখালীতে রুমানা আক্তার নামের এক কিশোরীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায় তিন সৎভাইয়ের বিরুদ্ধে। প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের অভিযোগ তুলে তিন ভাই তাদের নবম শ্রেণিতে পড়–য়া সৎবোনকে পেটানোর পর তার মৃত্যু হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এর আগে গত ২ মে কর্ণফুলী নদী তির থেকে উদ্ধার করা হয় সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের লাশ। পুলিশ তার বন্ধু আদনান মির্জাকে গ্রেফতার করে ঘটনার দিনই। আদনানও একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে মাসখানেক আগে আদনানের সঙ্গে তাসফিয়ার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় বলে পুলিশ জানায়। আদনানের সঙ্গে দেখা করতে বাসা থেকে বেরিয়েই নিখোঁজ হন তাসফিয়া, পরে লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ এখনো তাসফিয়ার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চট্টগ্রাম বিভাগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মামুনুল হক চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণেই অপরাধী চক্র চট্টগ্রামে খুন-ছিনতাই চালিয়ে যেতে পারছে। কোন এলাকায় কোন অপরাধী চক্র সক্রিয়, তার সব তথ্য তো তাদের নখদর্পণে থাকার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
এদিকে, চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়ে গেছে। গত সোমবার রাতে নগরের মেরিনার্স রোডে এক রিকশাচালককে ছুরি মেরে ছিনতাইয়ের চেষ্টার সময় তিনজনকে ধরে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয়রা। রমজানে ছিনতাই ঠেকাতে গোয়েন্দা পুলিশের ১০টি দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অধিকাংশ অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে অপরাধ তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে। অপরাধী যে-ই হোক, কাউকে ছাড়া হবে না- এটা যে কথার কথা নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজেই প্রমাণ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম বলেন, খুনের ঘটনাগুলোয় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। অপরাধ করে কেউ পার পাচ্ছে না। সুতরাং, এ নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই। তিনি বলেন, চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই ঠেকাতে আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি। তালিকাভুক্ত যেসব অপরাধী আছে তাদেরকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত যেসব অপরাধী জামিন পাচ্ছে, তাদেরকে কারাফটকে ফের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
"