এস এইচ এম তরিকুল, রাজশাহী
লেনদেনে অতি সতর্কতা * মাসোহারা পায় প্রশাসন!
সোনাইকান্দি ও বেড়পাড়া মাদকের স্বর্গরাজ্য
রাজশাহীর পবা উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী সীমান্তবর্তী গ্রাম সোনাইকান্দি ও বেড়পাড়া। পদ্মার ওপারেই ভারত। গ্রাম দুটি এখন মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্য। এখানে হাত বাড়ালেই মেলে যে কোনো ধরনের মাদক আর ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা পণ্য। শুধু মাদক আর অবৈধ পথে আসা পণ্যই নয়, অর্ডার দিলে পাওয়া যায় অবৈধ অস্ত্রও। চোরাকারবারিরা বলছে, টাকা দিলে ‘বাঘের চোখও’ মেলে। তবে শুধু পুরাতন পার্টির কাছ থেকেই অর্ডার নেওয়া হয়। খুব সতর্কতার সঙ্গে লেনদেন হয়। আর প্রশাসন পায় নিয়মিত মাসোহারা। ফলে হোতারা থাকছেন অধরা।
সাংবাদিকতার পরিচয় গোপন রেখে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই এলাকার স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য দেদার বিক্রি হচ্ছে। চোরাকারবারিদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের রয়েছে যোগসাজশ। ফলে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাদক কারবারিরা। সাধারণ মানুষ তাদের কাছে অসহায়। সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর হওয়ায়, মাদক কারবারিরা দুর্গম চরে গিয়ে পরিচালিত করছে তাদের অবৈধ কার্যক্রম। এসব চরের ফসলের ক্ষেতই এখন চোরাকারবারিদের অভায়শ্রম। মাদকদ্রব্য, অবৈধ পণ্য ও অস্ত্র পরিবহনে একং লেনদেনে কাজে লাগানো হয় দরিদ্র যুবকদের। দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের দিয়েই চলে ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন। এদের কেউ প্রথমেই সন্দেহ করে না। এ কারণে দরিদ্ররাই টার্গেট। এভাবেই পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে মাদকে। আর ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে যুবসমাজ। বাড়ছে চুরি-ছিনতাই, যৌন হয়রানি আর ইভটিজিং।
ওই এলাকার পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, কেউ প্রতিবাদ করলে, তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। এমনকি প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আটক করে উল্টো মাদক মামলায় ফাঁসানো হয়। ফলে প্রতিবাদ করাও দুসাধ্য হয়ে উঠেছে সেখানে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগও করেছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সোনাইকান্দি গ্রামের রমজান আলী, খাদিজা বেগম, আজিজুল হক কটু, রাজন, সাবদুলসহ আরো বেশ কয়েকজন দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় মাদকের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। তাদের ভয়ে স্থানীয়রা মুখ খুলতে সাহস পান না। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে নির্যাতন।
সরেজমিন ক্রেতা সেজে মাদক কিনতে চাইলে মাদক ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা (ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা) বলে, ‘পরিচিত লোক সঙ্গে না আনলে মাল দেওয়া যাবে না। কারণ, এর আগে আইনের লোকেরা মাদক ক্রেতার বেশে এসে আমাদের লোকেদের ধরে নিয়ে গেছে। আপনারা প্রশাসনের লোক কি-না তা নিশ্চিত না হলে মাদক বিক্রি করা যাবে না।’ তারা পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘কয়েক দিন এসে আড্ডা দেন, পরিচিত হোন, চরে আমাদের সঙ্গে এসে পিকনিক করেন, আপনাকে ভালো করে বুঝি। তারপর সবকিছু পাবেন।’ তারা আরো বলেন, ‘মাদক তো মামুলি ব্যাপার, টাকা দেবেন ঘোড়া-হরিণ (অস্ত্র) সব পাবেন।’ তারা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রকে ‘ঘোড়া-হরিণ’ বলে অভিহিত করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাদক স¤্রাট বলেন, ‘ইটভাটা ও গাড়ির ব্যবসা করে ধরা খেয়েছি। এখন বাধ্য হয়ে এ পেশায় নেমেছি। প্রশাসনকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। সে চাঁদার পরিমাণও বেড়ে গেছে। এখন ব্যবসা করে শান্তি নাই।’ অপর এক মাদক স¤্রাজ্ঞী বলেন, ‘সম্প্রতি শুরু হওয়া অভিযানের কারণে এখন মালের দাম বেশি। তবে পরিচিত ছাড়া মাল দেওয়া সম্ভব নয়।’
নাম না প্রকাশ করা শর্তে সোনাইকান্দি গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রশাসন চোরাকারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায়। তাই এদের দেখেও না দেখার ভান করে। এই এলাকার অধিকাংশ পরিবারই চোরাচালানে যুক্ত।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) দামকুড়া হাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ‘মো. আবদুল লতিফ শাহ্্ জানান, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে রমজান আলী, খাদিজা, আজিজুল কটু, সাবদুলসহ চিহ্নিত ব্যবসায়ীরা পালিয়েছে। আর রাজন কারাগারে। চরে নতুন কৌশলে ব্যবসা পরিচালনার খবর পেয়েছি। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। আমাদের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যরাও অভিযান অব্যাহত রেখেছে। সোনাইকান্দি ও চরমাজারদিয়াড় এলাকায় ফাঁড়ি করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম জানান, এসব এলাকা কিছুদিন পূর্বেও পবা থানার আওতায় ছিল। উপজেলা পবা হলেও প্রশাসনিকভাবে আরএমপির অধীনে হওয়ার পর থেকে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাদক চোরকারবারিরা যতই কৌশল অবলম্বন করুক কোনো লাভ হবে না। এমনকি পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
"