প্রতীক ইজাজ

  ২৩ মে, ২০১৮

কলকাতা যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ঋণের অর্থ ছাড় নিয়ে আলোচনা হবে

দুই দিনের সরকারি সফরে আগামী ২৫ মে শুক্রবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করবেন তিনি। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া ডিলিট উপাধি গ্রহণ ও বক্তব্য প্রদান করবেন। এ সময় শান্তিনিকেতনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও আগামী বছরের শুরুতে ভারতের নির্বাচনের আগে দুই দেশের মধ্যকার প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি, বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের ঋণের অর্থ ছাড়সহ নানা দ্বিপক্ষীয় বিষয় আলোচনা হতে পারে। এই সফরটি প্রধানমন্ত্রী টু প্রধানমন্ত্রী নয় বিধায় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসার কথা নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে যেহেতু দেখা ও বৈঠক হবে; তাই তিস্তার ব্যাপারেও দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের আশা জেগেছে।

এসবের বাইরেও মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ভারত সফর হওয়ায় এবং এবার নিয়ে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হতে যাওয়ায়- এবারের সফরটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এদফায় ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ভারতের নির্বাচনের আগে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এবারের সময়েই তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দুই প্রধানমন্ত্রী আগেই আশাবাদ ব্যক্ত করায়, এবারের সফরে তিস্তার ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর আগে ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মনমোহন সিংয়ের সফরে যে পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল তা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বেঁকে বসায় শেষমুহূর্তে বাতিল হয়ে যায়। পরে ২০১৫ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ঢাকায় এলে আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান সময়েই এবং ভারতের পরবর্তী নির্বাচনের আগেই তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুটিও আলোচনায় আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সরকারের কূটনৈতিক সূত্রগুলো। সূত্রমতে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতে পাশে চায় বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে ভারতও তাদের সম্মতি জানিয়েছে।

এর আগে গত এপ্রিলে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সেখানেও দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে মাসেই বিজেপির আমন্ত্রণে তিন দিনের ভারত সফর করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল। সেখানেও তিস্তাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

নানা ইস্যুর বাইরেও জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে হওয়ায় এবারের সফর বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। নির্বাচনী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে চাইছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দুই দেশই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। সেক্ষেত্রে সফরকালীন নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হলেও তা ইতিবাচক হবে। কারণ বর্তমান সরকারও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। তা ছাড়া নির্বাচনী বছরে অমীমাংসিত কিছু বিষয়ে, বিশেষ করে তিস্তার ব্যাপারে জোরালো প্রতিশ্রুতি আদায় করা গেলেও সরকারের জন্য ভালো হবে। এ ছাড়া ভারত যে ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে অর্থ কিছুটা ছাড় করা গেলে ও প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি হলে সরকারের পক্ষেই যাবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, মোদির সঙ্গে যে বৈঠক, সেটি আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক নয়। সফরে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা রয়েছে। সুতরাং, সফরটি দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুই দেশই চায় সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। বিশেষ করে চীনের কারণে ভারত এখন বাংলাদেশকে পাশে চায়। সুসম্পর্ক চায়। কারণ চীনকে নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে।

এই বিশ্লেষক বলেন, তিস্তা চুক্তি আগেই হওয়ার কথা। কিন্তু মমতার কারণে হয়নি। গতবারও সফরের সময় তিস্তা চুক্তির আশা ছিল। হয়নি। সুতরাং, সব সফরের মতো এবারও তিস্তার ব্যাপারে আশা আছে। বিশেষ করে ঋণের অর্থ ছাড়ের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কিছু ঋণের যে শর্ত, সেগুলো পূরণ করা কঠিন। এগুলো নিয়ে আলোচনা হবে।

মূল লক্ষ্য ঋণের অর্থ ছাড় : বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, এবারের সফরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মূল বিষয় বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের ঋণের অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে আলোচনা। এ বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও আগামী বছরের শুরুতে ভারতের নির্বাচনের আগে দুই দেশের মধ্যকার প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে চান। তাছাড়া অমীমাংসিত তিস্তার বিষয়েও দুই রাষ্ট্রপ্রধান এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে। তবে যেহেতু এই সফরটি প্রধানমন্ত্রী টু প্রধানমন্ত্রী নয়, তাই তিস্তায় কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা নয়। তবে তিস্তার বিষয়ে জোরালো প্রতিশ্রুতি আসতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ অর্থ ছাড়ের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। ইতোমধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, নরেন্দ্র মোদি জাতীয় নির্বাচনের আগে দুই দেশের মধ্যকার প্রকল্পগুলো শেষ করতে চান। এ বিষয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ে আলোচনার পাশাপাশি দুই রাষ্ট্র প্রধান কথা বলতে চান।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সূত্রমতে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশকে তিন দফায় ভারত মোট ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০১১ সালে দেওয়া হয় ১০০ কোটি ডলার। তার মধ্যে ২০ কোটি ডলার ছিল অনুদান। চার বছর পর ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আরো ২০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এরপর শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ৫০০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ৫০ কোটি ডলার নির্ধারিত সামরিক খাতের জন্য। বাকি ৪৫০ কোটি ডলার কোন কোন খাতে ব্যবহৃত হবে, সেই রূপরেখার কিছু কিছু তৈরি। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৮০ কোটি ডলারের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অর্থ এসেছে মাত্র ৩৮ কোটি ডলার। এসব প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে চান মোদি। তাছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও বার বার অর্থ ছাড়ের বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।

অর্থ বিভাগ আরো জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে ১৭ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ঋণচুক্তি সই হয়েছে গত বছরের ৪ অক্টোবর। ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষর হয় কোনো দেশকে দেওয়া ভারতের এ যাবৎ কালের সর্বোচ্চ ঋণচুক্তিটি। এর আগে আরো দুটো লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত মোট ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল, যার মাধ্যমে ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ।

এর আগে গত বছরের ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের যে ভারতীয় ঋণের ঘোষণা দেওয়া হয়; কোনো ঋণচুক্তির আওতায় ওই ঋণই ছিল দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বড় ঋণ। তারও আগে ২০১০ সালের ৭ আগস্ট ভারতের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি হয়। পরে অবশ্য ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার অনুদানে রূপান্তর করে ভারত। এ ছাড়া ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার দ্বিতীয় সমঝোতা চুক্তি হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, এর ফলে গত ছয় বছরে বাংলাদেশকে ভারতের দেওয়া মোট এলওসি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের টাকা কাজে লাগানোর জন্য সরকার ১৭ টি প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করেছে।

দুই দিনের সফরে যা যা থাকছে : সফরকালে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে যোগ দেবেন। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি উপস্থিত থাকবেন। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করবেন। এই ভবনে নির্মিত হয়েছে আধুনিক থিয়েটার, প্রদর্শনী কক্ষ, বিশাল লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে রয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পর্কিত গ্রন্থ। এ ছাড়া ভবনের প্রবেশদ্বারের দুই প্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। এরপর শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকে শেখ হাসিনা কলকাতা ফিরে এসে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী পরিদর্শন করবেন। সন্ধ্যায় হোটেল তাজ বেঙ্গলে কলকাতা চেম্বার নেতারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। পরদিন শনিবার আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ সমাবর্তনে শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করবে। শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist