কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঝুঁকি
* জেলা প্রশাসকদের কাছে ৮ নির্দেশনা * মিলছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ
মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রামের ২৮টি পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষ। সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন এসব পাহাড়ে বাড়ি ও ঘরভাড়া কম হওয়ায় স্বল্পআয়ের মানুষরা জমদূতের পরওয়ানা মাথায় নিয়ে বাস করছে সেখানে। এদিকে ভারী বর্ষণের সময় চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঝুঁকি বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। পাহাড়ধস ও প্রাণহানি ঠেকাতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ৮টি নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসকদের কাছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাহাড়ে বসবাসকারীরা অবৈধ উপায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পেয়েছে। তারা মাদক সেবন ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নগরীর ১৩টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি পরিবার বাস করছে। গত কয়েক বছরে পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে মারা গেছে ২০০ জন। ২০০৭ সালের ১১ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধস ট্র্যাজেডিতে ১২৭ জন মারা যায়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ধসে নিহত হয় ১১ জন। ২০১১ সালে নগরীর বাটালী হিলে পাহাড়ধসে ১১ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ২০১২ সালের ১ জুলাই নগরীর বাটালী হিল পাহাড়ের প্রতিরক্ষা দেয়ালধসে প্রাণ হারায় ১৭ জনসহ নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে মারা যান ২৪ জন। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৪ জুন পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ৩৭ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে পাহাড় এবং বনভূমি ধ্বংস করার কারণে এ বছরও বৃষ্টিতে ব্যাপক পাহাড়ধসের ঝুঁকি রয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসককে গত ২০ মার্চ পাঠানো এ বার্তায় পাহাড়ধস রোধে ৮টি নির্দেশনা দিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান। নির্দেশনাগুলো হচ্ছেÑ আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই পাহাড়ের পাদদেশ ও ঢালে বসবাসকারীদের অন্যত্র আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাহাড়ে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে অন্যত্র আবাসনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি পাহাড়ে নতুন করে বসতি ও ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ, অননুমোদিত পাহাড় কাটা বন্ধ ও ন্যাড়া পাহাড়ে গভীর শিকড়যুক্ত গাছ লাগানো হবে। যেসব পাহাড়ের পাদদেশের ঢালু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী গাইড ওয়াল, পানি নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর তৈরি করা, পাহাড় কাটা ও ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে পাহাড় কাটা বন্ধ করা, পাহাড় কাটার কুফল সম্পর্কে পাহাড়ি এলাকার জনগণকে সচেতন করা, পাহাড় কাটা বিষয়ক মামলা রুজু, তদন্ত ও বিচার সুষ্ঠু এবং দ্রুততর করার জন্য পরিবেশ অধিদফতরকে অবগত করা।
এদিকে ‘চট্টগ্রাম জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস, পাহাড় কর্তন ও করণীয় সম্পর্কে রূপরেখা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে জমা দেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী। প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম জেলায় প্রায় ৫০০ পাহাড় আছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের এলাকায় সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ঝুঁকিপূর্ণ ২৮টি পাহাড় আছে। এসব পাহাড়ে ৬৮৪ পরিবার বসবাস করছে।
বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের কাছে জমা দেওয়া জেলা প্রশাসকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পাহাড় ধ্বংসে প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। বিরাজমান সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো মূল্যে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব পরিবারে আছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধা। এতে আরো বলা হয়েছে, পাহাড়ধসে ভৌগলিক কারণ কিছুটা দায়ী হলেও এর চেয়ে বড় দায়ী নির্বিচারে পাহাড় কর্তন, পাহাড় ব্যবস্থাপনায় নীতিমালা না থাকা, পাহাড় নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তায়ন। তবে এসব ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী। প্রতিবেদনে অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীরা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, পাহাড়ে বসবাসকারীরা অবৈধ উপায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়সহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ তথা মাদক সেবন ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া পাহাড়ে বসবাসকারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এক শ্রেণির প্রভাবশালী দালালচক্র দেশের আইনশৃঙ্খলাকে অমান্য করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসব পাহাড়কে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে ভাড়া দেয়।
পাহাড় কাটার ফলে চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো হচ্ছে টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ পশ্চিম কোণের পাহাড়, সিআরবির পাদদেশ, টাইগার পাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড় ও আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়। সড়ক ও জনপথ, রেলওয়ে, গণপূর্ত ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মালিকাধীন পরিবেশ অধিদফতর সংলগ্ন পাহাড় ও লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকায় রয়েছে। বাকি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো হচ্ছে বন বিভাগের বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়। ইস্পাহানি গ্রুপের ইস্পাহানি পাহাড়। জেলা প্রশাসনের ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড় মোড় সংলগ্ন পাহাড়, এ কে খান কোম্পানির এ কে খান কোম্পানি পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনির পাহাড়, ভিপি লিজভুক্ত লালখান বাজার, চান্দমারি রোড সংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম ইসলামী মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়, সরকারি (এপি সম্পত্তি) নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়। চট্টগ্রামে পাহাড় দখলের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নাম সর্বস্ব সংগঠন পর্যন্ত। দখলদারদের তালিকায় রয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। বাদ যায়নি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও।
গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড় দখলের পর তা কেটে পরিণত করা হয়েছে সমতল ভূমিতে। সীতাকুন্ডে পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা। এমনকি প্লট তৈরি করে বিক্রির ঘটনাও ঘটছে। জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। এই এলাকায় এরই মধ্যে শত শত একর পাহাড় কেটেছে কথিত ছিন্নমূল নামে একটি সংগঠন। তারা এরই মধ্যে পাহাড় কেটে ছিন্নমূলদের জন্য তৈরি করা করেছে হাজার হাজার বসতবাড়ি। এখনো পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করে নদীভাঙা মানুষদের কাছে বিক্রি করা অভিযোগ রয়েছে। পাহাড়ে এই অবৈধ বসতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০০৪ সালে একাধিক পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ২০১০ সালে স্থানীয় লাল বাদশা ও আলী আক্কাসের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। চলতি বছর জুলাই মাসে জঙ্গল সলিমপুরের বিবিরহাট এলাকায় পাহাড়ধসে তিন শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটার পর এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ায় প্রশাসন। পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জঙ্গল সলিমপুরে অভিযান চালিয়ে ছিন্নমূল বস্তিবাসী নেতা কাজী মশিউর রহমানকে তার বাসা থেকে অস্ত্রসহ ধরে র্যাব; ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় বিদেশি পিস্তল ও গুলি।
জঙ্গল সলিমপুর এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, পাহাড় কেটে প্লট করে লাখ লাখ টাকা দিয়ে নদীভাঙা মানুষদের কাছে বিক্রি করছে। তাদের বিষয়ে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ সঙ্গে সরকারি দলের লোকরাও জড়িত। এদিকে গত কয়েক বছরে সীতাকুন্ডের শীতলপুর এলাকার অর্ধশতাধিক ছোট ও বড় পাহাড় কেটে তা সমতল ভূমিতে পরিণত করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানা। পাহাড় কাটার উৎসব চলছে উপজেলার কুমিরা, ফৌজদারহাট, বাঁশবাড়িয়া, সুলতানা মন্দির, কদম রসুল, বাড়বকুন্ড, ভাটিয়ারীসহ বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড়ি ভূমি কেটে পরিণত করা হয়েছে সমতল ভূমিতে। এছাড়া ইটভাটার নামেও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চলছে পাহাড় কাটার উৎসব।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে পাহাড় কাটা বন্ধ করা ও পাহাড় থেকে বসতি উচ্ছেদের দিকে জোর দিচ্ছি আমরা। এছাড়া পাহাড় কাটার কুফল সম্পর্কে পাহাড়ি এলাকার জনগণকে সচেতন করার কাজও চলছে।
"