খুলনা প্রতিনিধি
কেন্দ্র দখল জাল ভোট ভাঙচুর গোলাগুলি
ইসির পর্যবেক্ষক লাঞ্ছিত : ৩ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত
কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ভাঙচুর ও গোলাগুলির মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার শেষ হলো খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন। এদিকে জাল ভোট এবং ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করায় ৩ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এছাড়া খোদ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একজন পর্যবেক্ষককেও লাঞ্ছিত করার খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ, ২১নং ওয়ার্ডের প্রভাতী স্কুল, পোর্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সেন্ট জোসেফস স্কুল, খুলনা নেছারিয়া কামিল মাদরাসা, বয়রা ইউসেফ স্কুল, সবুরুন্নেসা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র, প্রভাতী রেলওয়ে সরকারি বিদ্যালয়, খুলনা জিলা স্কুল (নতুন ভবন) কেন্দ্রে দুপুর ১২টার আগেই ভোট শেষ হয়ে যায়। এইচ আর এইচ প্রিন্স আগাখান মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মারতে পুলিশ অংশ নেয়।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী জানিয়েছেন, জাল ভোট দেওয়ার ঘটনায় ২৪নং ওয়ার্ডের সরকারি ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, ৩১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় এবং ২২নং ওয়ার্ডের ফাতিমা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি বুথে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ৩০নং ওয়ার্ডে রূপসা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ও রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুটি ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ ১ ঘন্টারও বেশি সময় স্থগিত রাখা হয়। এ কেন্দ্রের ২নং বুথে ভোট দিতে গিয়ে ফিরে যান মাদরাসা শিক্ষক মো. শরীফুল ইসলাম। তিনি জানান, তিনি দু’দফা চেষ্টা করেও নিজের ভোটটি দিতে পারেননি। তার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে বলে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তার ভোটার নং ৫১৫। অপরদিকে, নগরীর ২৬নং ওয়ার্ডের সেন্ট জেভিয়ার্স মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে গেলেও পারেননি বেসরকারি চাকরিজীবী মো. শওকত হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাকে জানান, তার ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। পরে তিনি কারণ জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট পোলিং অফিসার জোর করে তার আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দেন। এতে তিনি আরও উত্তেজিত হলে ‘ভুল হয়েছে’ মর্মে তার কাছে ক্ষমা চান সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে বেলা পৌনে ১২টায় সরকারি ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের (পুরুষ) ৭নং বুথের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নূর ইসলামের কাছ থেকে ১৫-২০ জন বহিরাগত যুবক ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে বাক্স ভরেন। এ ঘটনায় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার খলিলুর রহমান ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেন। ৩১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়েও কাউন্সিলর প্রার্থী এসএম আসাদুজ্জামান রাসেলের ঝুড়ি প্রতীকে ব্যালট ছিনিয়ে সিল মারায় দুপুর সোয়া ২টায় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আলী হোসেন ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেন। রূপসা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রেও একদল দুষ্কৃৃতকারী জোরপূর্বক কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢোকায়। এ ঘটনায় প্রিসাইডিং অফিসার ইবনুর রহমান ঘন্টাব্যাপী ভোট প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রাখেন। এ সময় ভোটাররা ভোট দিতে এলে ব্যালট পেপার নেই বলে ফিরিয়ে দেন সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা। ভোট দিতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভোটার হোসেন সানা, আল আমিন শেখ, জাহিদুল ইসলাম, মো. সোলায়মান, তারেক মাহমুদ সোহেল, হাফিজুর রহমান, মো. আসলামসহ অনেকেই। এ কেন্দ্রের ৩নং বুথের পোলিং অফিসার মাসুদুর রহমান বলেন, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছু সময় তারা ভোট নিতে পারছেন না। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ফাতেমা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেন প্রিসাইডিং অফিসার জিয়াউল হক।
এদিকে, অন্তত ১০টি কেন্দ্রের বাইরে বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২৪নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শমসের আলী মিন্টু বলেন, যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনের নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগ নেতা এস এম কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে বিএনপির ক্যাম্প ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে, বিজিবিও কিছু করেনি।
এ বিষয়ে খুলনার সহকারী পুলিশ কমিশনার আল বেরুনী বলেন, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙা আচরণবিধি লঙ্ঘন, ঠিক হয়নি। আমরা খোঁজ নিচ্ছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি।
অপরদিকে, ২২নং ওয়ার্ডের আ’লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বিকুর ছোট ভাই কাজী বেলায়েত হোসেন নতুন বাজার হাজী আবু হানিফ কেরাতুল কোরআন নূরানী মাদরাসা কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো এজেন্ট ঢুকতে দেননি। খুলনা জিলা স্কুল কেন্দ্রের ৮টি বুথেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ধানের শীষের কোনো এজেন্ট ঢুকতে দেননি। তবে, এ কেন্দ্রের ৬নং বুথে ধানের শীষের এজেন্ট সিরাজুল ইসলাম লিটন মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর উপস্থিতিতে সকাল ১০টায় কেন্দ্রে ঢুকতে সক্ষম হন।
অপরদিকে, খালিশপুর ১১নং ওয়ার্ডের জামিয়াহ ত্বৈয়্যেবাহ নূরানী তালিমুল কোরআন মাদরাসা কেন্দ্র থেকে সহোদর সিরাজকে কুপিয়ে এবং আলমকে মারধর করা হয়। এছাড়া এ ওয়ার্ডে জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল উলুম বয়স্ক মাদরাসা কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী জামান মোল্লা জেলিনের এজেন্ট আসাদ ও হাবিবকে সকালেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়। দুপুর আড়াইটায় এ কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ছিনতাই করা হয়। যার কোনো সন্ধান এখনো মেলাতে পারেননি নির্বাচন কর্মকর্তারা। খালিশপুরস্থ ৭নং ওয়ার্ডের মোহাম্মদিয়া ফেরদৌসিয়া হাফিজিয়া নূরানী মাদরাসা ও এতিমখানা কেন্দ্রে জাল ভোট দিতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পুলিশ ১১ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। তবে, এতে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। দৌলতপুরস্থ পাবলা এলাকার ৬নং ওয়ার্ডের শের-ই-বাংলা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে বহিরাগতদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে পুলিশের রাইফেলের বাঁট ভেঙে যায় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
খুলনা সিটি নির্বাচনে ইসির পর্যবেক্ষক দলের প্রধান সমন্বয়কারী ইসির যুগ্মসচিব আবদুল বাতেন বলেন, আমি অন্তত ২০টি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। সেখানে কেউ অভিযোগ স্বীকার করছে না। কিন্তু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার তথ্য গণমাধ্যম ও নানা সোর্সে পাচ্ছি। যেখানেই অভিযোগ পাচ্ছি, ছুটে যাচ্ছি। তবে, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে হয়েছে বলে মন্তব্য করে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী বলেন, ৫-৬টি কেন্দ্রের অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছি।
ইসির পর্যবেক্ষক লাঞ্ছিত : ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণে গেলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সমর্থকরা নির্বাচন কমিশনের একজন পর্যবেক্ষককে লাঞ্ছিত করেছেন। ভোটগ্রহণ শুরুর কিছুক্ষণ পরেই তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। ভোট পর্যবেক্ষণে ইসি’র ওই কর্মকর্তা নড়াইল থেকে খুলনায় গিয়েছিলেন। ওই কেন্দ্রের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নুরানী বহুমুখী মাদরাসা বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। ঠেলাগাড়ি প্রতীকের সমর্থকরা ওই পর্যবেক্ষকের সঙ্গে থাকা একটি গাড়ি ভাঙচুরেরও চেষ্টা চালায়। ওই ভোটকেন্দ্রের (পুরুষ) প্রিসাইডিং অফিসার মিজানুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ইসির নিজস্ব এক পর্যবেক্ষকের সঙ্গে সকালে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে।
"