জুবায়ের চৌধুরী

  ২৭ এপ্রিল, ২০১৮

সব পুলিশ এমন হলে বদলে যেত বাংলাদেশ

পুলিশের ভালো কাজগুলো সাধারণত মানুষের নজরে আসে কম। আর সাধারণ মানুষ সুনাম তো দূরের কথা পুলিশ শব্দটাকেই পারলে এড়িয়ে চলে। এর পেছনে অবশ্য অনেক যুক্তিও হয়ত আছে। কিন্তু আসলেই কি পুলিশের সব সদস্য খারাপ? ভালো কাজ যদি তারা না-ই করেন, তাহলে দেশ চলছে কীভাবে? প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও অনেক ভালো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু প্রচারের অভাবে সাধারণ মানুষের কাছে আসতে পারেন না তারা।

তবে সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে পুলিশের খারাপ কাজের পাশাপাশি ভালো কাজও ছড়িয়ে পড়ছে মুহূর্তেই। সম্প্রতি পুরানা পল্টনে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেনের হাতে লাঞ্ছিত হলেন একজন টিভি সাংবাদিক। এর কয়েক দিন আগে একজন ফটোসাংবাদিকও পুলিশের হাতে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত হন। সেসব ঘটনায়ও নিন্দার ঝড় ওঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকে গোসল করায় পুলিশের হাতে এক শিশুকে মারধরের ভিডিও ফেসবুক ও গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।

আবার অনাথ ও ছিন্নমূল শিশুকে এক পুলিশ সদস্য আদর-ভালোবাসা সহকারে পড়াচ্ছেন-খাওয়াচ্ছেন, বৃদ্ধকে সযতেœ রাস্তা পার করে দিচ্ছেন কিংবা অসহায় দিনমজুরের মুখে তুলে দিচ্ছেন খাবার, পুলিশের এমন নানা ভালো কাজের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বলছেন, ‘বাংলাদেশের পুলিশ সবাই খারাপ নয়। হয়তো একটা অংশ আছে খারাপ কিন্তু ভালো পুলিশ সদস্যও আছেন। যারা সব সময় জনগণের সেবায় তৎপর, সাধারণ মানুষের যেকোনো বিপদে দ্রুত তাদের হাত প্রসারিত হয়।’ সর্বশেষ গুলশান বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) শবনম আক্তার পপির আহতকে সেবা দেওয়ার ছবি ভাইরাল হয়েছে। একই ঘটনায় দুর্ঘটনাকবলিত একটি গাড়ি নিজে চালিয়ে জনসাধারণকে দুর্বিসহ যানজট থেকে মুক্তি দেন তিনি। তার এই অসাধারণ কীর্তিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। অনেকেই তাকে পুলিশের ‘রোল মডেল’ বলতেও কার্পণ্য করছে না। তবে শবনম মনে করেন, এসব কাজ পুলিশের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আর পুলিশ সদস্যরা এমন কাজ প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছেন। তাদের সেসব কাজ কর্তব্য হিসেবেই ধরা হয়।

দিনটি ছিল ২২ এপ্রিল। এসআই শবনম আক্তার পপি টহল দিচ্ছেন মহাখালী এলাকায়। রুটিন ডিউটি। হঠাৎ ওয়্যারলেসে বার্তা এলো, মহাখালীতে এক্সিডেন্ট হয়েছে। দ্রুতই ছুটে গেলেন মহাখালীর দিকে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন ভয়াবহ পরিস্থিতি। রাস্তায় উল্টে আছে গাড়ি। পথ বন্ধ। বিরাট বিশৃঙ্খলা। সেদিন পুলিশের এসআই শবনম আক্তার পপি যা যা করেছিলেন, সেটিকে তিনি ভেবেছিলেন পুলিশ হিসেবে তার কর্তব্য কিংবা কাজেরই অংশ হিসেবে। কিন্তু যারা সেদিন ঘটনাটি দেখেছেন, ছবি তুলেছেন এবং সেই ঘটনার কাহিনী এবং ছবি অনলাইনে শেয়ার করেছেন, তাদের কাছে এটি ছিল বিরল এবং অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত। দেশের পুলিশ বাহিনী যেখানে প্রতিদিন নানা কাজের জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে, কিছু পুলিশ সদস্যদের নানা কান্ড-কীর্তির কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, সেখানে শবনম আক্তার পপিকে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশের ‘আদর্শ’ বা ‘রোল মডেল’ হিসেবে ভূষিত করা হচ্ছে। এটা পুলিশের জন্য একটা বিরাট অর্জন।

সেদিন যা ঘটেছিল : ফোনে শবনম আক্তার পপি মহাখালী ফ্লাইওভারের সেই দুর্ঘটনার পর সেদিন সেখানে কী হয়েছিল, নানা প্রশ্নের উত্তরে সবিস্তারে জানিয়েছেন। শবনম বলেন, ভিআইপি পরিবহনের বাসটি যখন ফ্লাইওভার থেকে নিচে নামছিল, তখন সেটি ব্রেক ফেল করে সামনের গাড়িতে ধাক্কা মারে। ধাক্কাটা আসলে জোরেশোরেই ছিল। পরপর ১০টি গাড়িতে ধাক্কা লাগে। একটা পিকআপ ভ্যান উল্টে একজন মারাত্মকভাবে আহত। কয়েকজন মোটরবাইক আরোহীও আহত হয়েছেন। ভিআইপি পরিবহনের গাড়িটা বিকল হয়ে পড়ে ছিল একেবারে মাঝ রাস্তায়। এর ফলে সেখানে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই কীভাবে গাড়িটা সরানো যায়, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি নিজেই গাড়িটা চালিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেব।

শবনম বলেন, আমার মনে হয়েছিল তখন যদি আমি দ্রুত গাড়িটা রাস্তা থেকে সরিয়ে না নেই তাহলে আমার ডিপার্টমেন্টের বদনাম হবে। আর আমার ডিপার্টমেন্ট এই ট্রেনিংটাই দেয় মানুষের সেবা করা, বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা। আমাদের কিন্তু ট্রেনিংয়ে এটাই শেখানো হয়। তিনি গাড়ি চালানো শিখেছিলেন নিজের আগ্রহেই। পরে পুলিশ সদস্য হিসেবেও গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। কাজেই বাসটি চালিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি। তবে কিছুটা ভয় কাজ করছিল যেহেতু বাসটির ব্রেক কাজ করছিল না। যে পিকআপটি রাস্তায় উল্টে গিয়েছিল তার ড্রাইভার আহত হয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়। ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। তাকে ফার্স্টএইড দেওয়ার কাজেও এগিয়ে গেলেন শবনম।

আহতকে সেবা দেওয়ার সেই ছবিটিই ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হয়েছে। শবনম বলছিলেন, আহতের অবস্থা দেখে একজনকে টাকা দিয়ে বললাম কিছু বরফের টুকরো এনে দিন। আহত লোকটিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম আপনার কিছুই হয়নি। একপর্যায়ে তার আঘাতের জায়গাগুলোতে বরফের সেঁক দেই। বরফসহ গামছা দিয়ে বেঁধে দেই। তখন মনে হচ্ছিল, যদি তাকে প্রাথমিক চিকিৎসটা না দেই, এই পা হয়তো আর ভালোই হবে না। তিনি জানান, বাংলাদেশ পুলিশ এখন অনেক এগিয়ে। আমাদের ড্রাইভিং, ফার্স্টএইডসহ অনেক কিছুই শেখানো হয়।

বাংলাদেশে গত কয়েক দিন ধরেই যেখানে কিছু পুলিশ কর্মকর্তার কান্ড-কীর্তি নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে, সেই পটভূমিতে শবনম আক্তার পপির এই ভূমিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। এই ঘটনার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন অনেকে। সেদিন আহত এক মানুষকে তার ফার্স্টএইড দেয়ার ঘটনার ছবির নিচে মন্তব্য করেছেন অনেকে। রহমান আজিজ নামে একজন প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু সেটা পপি আপা দেখালেন। তবে সব পুলিশ যদি এমন হতো তবে বদলে যেত বাংলাদেশ।’ হাসান ইমাম নামে একজনের মন্তব্য, ‘শত সহস্র সালাম সেসব পুলিশ সদস্যদের যারা সত্যিকারের পুলিশের সম্মান রেখে জনগণের সেবা করে। এদের কাছ থেকেও তো খারাপ পুলিশরা কিছু শিখতে পারে!!’

ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ এসআই শবনমের এই কীর্তি নিয়ে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত একজন পথচারীর পায়ের শুশ্রƒষা করছেন একজন পুলিশ সদস্য। এই ছবি শুধু পুলিশের সেবার কথা বলে না, পরিবর্তনের কথাও বলে। শ্রদ্ধা।’ এক বছর আগেও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার কনস্টেবল লুৎফা আক্তারের সাইকেল চালিয়ে অফিসে আসার ছবিটি ব্যাপক ভাইরাল হয়। লুৎফার সেই ছবিটিও ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন গুলশানের ডিসি মোস্তাক আহমেদ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে এই শোরগোল বিষয়টিকে বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন এসআই শবনম আক্তার পপি। তিনি বলেন, ‘মোস্তাক স্যার আমাকে নিয়ে ফেসবুকে যে পোস্টটি দিয়েছেন, সেটি আমার অন্তর ছুঁয়ে গেছে।’ তবে যে কাজ তিনি সেদিন করেছেন, সেটি যে অসাধারণ কিছু সেটা তিনি মনে করেন না। তার মতে, পুলিশের এই কাজই করার কথা। এসআই শবনম বলেন, ‘আমি সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সেবা করার চেষ্টা করি। আর এখন পুলিশের কাজ আমাকে এই কাজ আরো বড় পরিসরে করার সুযোগ করে দিয়েছে।’ পুলিশের যে নেতিবাচক ভাবমূর্তির কথা সব সময় বলা হয়, তার সঙ্গেও একমত নন তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist