প্রতীক ইজাজ
কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রশংসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
অনেক অর্জন বাংলাদেশের
কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান, নারীর ক্ষমতায়ন, বাণিজ্যে বিনিয়োগসহ দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রশংসা করেছেন সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। বিশ্ব নেতৃত্ব বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে চাপ দিতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে ৫৩ জাতির সংস্থা কমনওয়েলথ। নারীর ক্ষমতায়নে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে বাংলাদেশ থেকে অভিজ্ঞতা নিতে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থা। এমনকি সংস্থার বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি বাংলাদেশেও বাণিজ্য বাড়াতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে।
সম্মেলনে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এবং ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক ও মতবিনিময় করেছেন। এসব বৈঠকে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেমন উঠে এসেছে; তেমনি গুরুত্ব পেয়েছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও রাজনীতি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে রাষ্ট্রগুলোর দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে।
বিশেষ করে বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যতিক্রমী বক্তব্য, তার প্রস্তাবনা ও সুপারিশের প্রতিও বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে কমনওয়েলথের আমূল সংস্কারের জন্য শেখ হাসিনার প্রস্তাবনা ও পরামর্শযুক্ত বক্তব্য সমগ্র সম্মেলনে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার ‘পথপ্রদর্শক নেতৃত্বের’ ভূমিকার প্রশংসা করে কমনওয়েলথ নেতাদের তার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরব উপস্থিতি ও উচ্চকণ্ঠ বাংলাদেশের পাশাপাশি শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছে। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছেন তিনি বিশ্ব নেতাদের কাছে। এ সময় তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশে জঙ্গি মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো প্রতিরোধে সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বাড়ানো ও দারিদ্র্যবিমোচনসহ দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরেন। এমনকি ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও দীর্ঘদিন ব্রিটেনে পালিয়ে থাকা দ-প্রাপ্ত আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার বিষয় নিয়েও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কথা বলতেও ভোলেননি শেখ হাসিনা।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে এভাবেই বিশ্লেষণ করলেন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা এ সম্মেলনকে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ‘বিশেষ মর্যাদার ও অর্জন’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, রোহিঙ্গা ইস্যু ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিকে অনুসরণের আহ্বান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা আরো বাড়িয়েছে। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশেষ আসনে আসীন হয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ল। এই অবস্থান বাণিজ্যে বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নানাভাবে সহযোগিতা করবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন বলেন, এসব সম্মেলনে যেসব বিষয় আলোচনায় আসে সেগুলো লিখিত কিছু নয়, অনানুষ্ঠানিক আলোচনা। তবে এবার বাংলাদেশের যেসব বিষয় সম্মেলনে উঠেছে, বিশ্ব নেতারা আলোচনা ও প্রশংসা করেছেন বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে; সেটি বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। বাংলাদেশের এমন সরব উপস্থাপনের ফলে কমনওয়েলথ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটি লিখিত প্রস্তাব করেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে যেন সহযোগিতা করা হয়, বিশ্ব নেতারা একমতে পৌঁছেছেন। এটাও বড় অর্জন। বিশেষ করে এই সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেল সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।
এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, প্রধানমন্ত্রী উচ্চকিত ছিলেন। উচ্চকণ্ঠে সব বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। বিশ্বের এত নেতা তারা সবাই বাংলাদেশকে জানল। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কথা বলেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন দরকার কূটনৈতিকভাবে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা। এছাড়া আমরা নিজেদের বিশ্ব নেতাদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছি। দৃশ্যমান হয়েছি। তারা বাংলাদেশের কথা শুনেছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন। অনেক কাজের প্রশংসা করেছেন। এমনকি নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশকে অনুসরণ করার কথা বলেছে কমনওয়েলথ। এসব বড় অর্জন।
সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যে ৮ দিনের সফর শেষে গতকাল দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সৌদি আরবে বহুজাতিক সামরিক মহড়া ‘গাল্ফ শিল্ড ওয়ানের’ সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে গত সোমবার রাতে লন্ডনে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে অংশ নেন।
কমনওয়েলথ সম্মেলন বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মর্যাদা এবং অর্জনের নানাদিক সম্পর্কে জানা গেছে। সম্মেলনে বক্তব্য ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং সম্মেলনের বিভিন্ন ফোরামে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও সে পরিপেক্ষিতে বিশ্ব নেতাদের অভিমত থেকে সম্মেলনের অর্জন সম্পর্কে বলেছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, সম্মেলনে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রশংসিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার কমনওয়েলথ ওমেন্স ফোরামের এক অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর সক্ষমতায় বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প শোনান। গল্প শুনে অধিবেশনের অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও তাদের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দিত ও বাংলাদেশের এ অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের হেড অব জেন্ডার এমিলিয়া সিয়ামমুয়া স্পষ্ট করে বলেন, ‘লিঙ্গ সমতা’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। পিছিয়ে থাকা দেশগুলো বাংলাদেশের এই সাফল্য অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবে। ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ সংগ্রামে বাংলাদেশের এই সাফল্য থেকে তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
গত জাতিসংঘ সম্মেলনের মতো কমনওয়েলথ সম্মেলনেও নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী সরব ছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, এবারের কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সফলতা রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোটভুক্ত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের ঐকমত্যে নিয়ে আসা। ফলে কমনওয়েলথের লন্ডন ঘোষণায় গুরুত্ব পায় রোহিঙ্গা সংকট। ঘোষণার ৫০ অনুচ্ছেদে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করারও তাগিদ দেয় কমনওয়েলথ।
বিশেষ করে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার লন্ডনের ন্যানক্যাস্টার হাউসে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যু ও দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত তাদের অবস্থান অনেক পরিবর্তন করেছে। তারা আমাদের অনেক কাছের। তাদের (রোহিঙ্গাদের) পুনর্বাসনে সহায়তা করছে। আগামী মে মাসের শেষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বিশেষ করে একটি অধিবেশনে বক্তৃতায় শেখ হাসিনার কমনওয়েলথ সংস্কারের প্রস্তাব বিশেষ দৃষ্টি কাড়ে বিশ্ব নেতাদের। সেখানে শেখ হাসিনা বলেন, কমনওয়েলথ সচিবালয়ের উচিত সংস্থাটির ঘোষিত কানেকটিভি, সাইবার নিরাপত্তা, সুশাসনের বিষয়ে একটি অ্যাকশন প্লান তৈরি করা। এ সময় শেখ হাসিনা সার্বিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও প্রগতির জন্য যোগাযোগ বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
এমনকি বিভিন্ন ব্যবসায়ী ফোরামের নেতাদের সঙ্গে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দেওয়া নানা সুবিধার কথা তুলে ধরে সেগুলোকে কাজে লাগাতে বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের এদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বলেন, আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এশিয়ার সবচেয়ে বেশি এফডিআই (প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ) প্রণোদনা দেওয়া দেশে আপনারা আমাদের সরকারের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন।
সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার ‘পথপ্রদর্শক নেতৃত্বের’ ভূমিকার প্রশংসা করে কমনওয়েলথ নেতাদের তার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, সেশনে কমনওয়েলথ মহাসচিবের উপস্থাপনা শেষে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে বিভিন্ন নেতার বক্তব্যের জন্য ফ্লোর উন্মুক্ত করে দেন। এ সময় ট্রুডো বলেন, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসাধারণ নেতৃত্বগুণ দেখিয়েছেন, কমনওয়েলথ নেতাদের অবশ্যই তাকে সমর্থন দিতে হবে।
"