জুবায়ের চৌধুরী

  ২০ এপ্রিল, ২০১৮

ধর্ষণ সহিংসতা থামছেই না

চলন্ত বাসে পোশাকশ্রমিককে ধর্ষণ, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ, চকলেটের লোভ দেখিয়ে শিশুকে ধর্ষণ, পথশিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ, নববধূকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ, চলন্ত বাসে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টাÑ এসব শিরোনামে খবর প্রকাশ হচ্ছে নিয়মিত। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। শুধু তা-ই নয়, নাচের জন্য বাসায় ডেকে তরুণীকে গণধর্ষণ, প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ, গোপন ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ, শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগী ধর্ষিতা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষিকা ধর্ষণÑ এমন ভয়ঙ্কর খবরে নাগরিক জীবনে অস্বস্তির মাত্রা যেন সীমা ছাড়িয়েছে।

এদিকে, গত বুধবার বিকালে ঢাকায় আবারও যাত্রীবাহী বাসে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। বাসাবোর বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাসে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে পরিবহনকর্মীরা। ঘটনার পর ফেসবুকে এক ভুক্তভোগী তরুণী ঘটনার বিবরণ দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার সেই পোস্টটিই ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওই ভুক্তভোগী তরুণী জাতীয় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ছাত্রী।

ওই ছাত্রী ফেসবুকে লেখেনÑ তারা দুই বান্ধবী সায়েদাবাদের উদ্দেশ্যে লাব্বাইক পরিবহনে উঠেছিলেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এলে বাস প্রায় খালি হয়ে যায়। এর আগে বাসে যাত্রী ছিল প্রায় ২৪ থেকে ২৫ জন। একপর্যায়ে বাসাবোতে পৌঁছলে আমরা ছাড়া মাত্র চারজন ছিল। বাসটি খিলগাঁও ফ্লাইওভার থেকে নামার পরপরই পরিবহনকর্মীরা আমাদের দুইজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখ চেপে ধরে। অনেক ধস্তাধস্তির পর নিজেদের কোনো রকমে বাঁচিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ি। কিন্তু ওই দুই ছাত্রী এ ঘটনায় কোথাও জিডি কিংবা মামলা করেনি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই ঘটনাটি জানানো চেষ্টা করেছে মাত্র। ঢাকার রাস্তায় এ রকম অনেক ঘটনাই ঘটে। তবে তা প্রকাশ পায় না।

ধর্ষণের চেষ্টা কিংবা ধর্ষণের মতো এই বীভৎসতার শেষ কোথায় তা কারোর-ই জানা নেই। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ভয়ঙ্কর এই বীভৎসতার। দিন যতই যাচ্ছে ধর্ষকদের কৌশল ও ধরন পাল্টাচ্ছে। তাদের এই বর্বরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহবধূ, প্রতিবন্ধী নারী, এমনকি শিশুরাও। অনেকেই পরিচিতজনের বিশ্বাসঘাতকতা ও নিজ ঘরে আপনজন কর্তৃক প্রতারিত হয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। থানা-পুলিশের কাছে ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে অনেককে সহ্য করতে হচ্ছে শারীরিক নিপীড়ন। এসব কারণে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নিন্দা ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি জানিয়ে মানববন্ধন এবং বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তবু যেন কমছে না জঘন্য এই বীভৎসতা!

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮১৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গণধর্ষণ ২০৬টি, ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ১০৪টি এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৭টি। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫১৪টি। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় কতটা নির্মমতা ও বীভৎসতা চলছে নারী এবং শিশুদের প্রতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিই নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। অনেক ঘটনায় ধর্ষণের প্রমাণ মেলে না। প্রমাণ করাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, এই বীভৎসতার শেষ কোথায়?

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সারা দেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২ হাজারের বেশি। ২০১৬ সালে প্রতি মাসে গড়ে সারা দেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩১০টি। ২০১৭ সালের প্রথম ৬ মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ৩১৯টি। এ হিসাবে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ার নানা কারণ রয়েছে। যেমনÑ মূল্যবোধ কমেছে এবং সামাজিক অবক্ষয় অনেক বেড়ে গেছে। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া দেশে বিচারহীনতার এক ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে। অনেক সময় বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলার আলামত নষ্ট হচ্ছে। এতে অপরাধীরা পার পাচ্ছে। আবার ধর্ষণের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের ওপর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতার প্রভাব রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে, অপরাধ করেও সব ম্যানেজ করা সম্ভব। সমাজ থেকে প্রচলিত এ ধারণা পাল্টাতে হবে। ধর্ষণের ঘটনায় যে মামলা হয়, প্রতিটি স্তরে তা তদারকি করা জরুরি। এটা করবে পুলিশ ও প্রসিকিউশন বিভাগ।

নারী ও শিশুর প্রতি পাশবিক সহিংসতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে প্রতিটি ছোট ছোট সেক্টরে গিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হলে এবং মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এ জাতীয় সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

গত দুই মাসের কয়েকটি ধর্ষণ কা- : ১ মার্চ ঢাকার ধামরাইয়ের গোপালকৃষ্ণপুর গ্রামে ধর্ষণের শিকার অষ্টম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীর গর্ভপাত ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে। ৫ মার্চ সাভারে এক যুবকের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রভোলন দেখিয়ে অষ্টম শ্রেণির (১৫) এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ৭ মার্চ রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৯ মার্চ রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ভাত খাওয়ানোর কথা বলে ৭ বছরের এক পথশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে বিল্লাল (৩৫) নামে এক হকারের বিরুদ্ধে।

৩ এপ্রিল সাভার উপজেলায় এক বাকপ্রতিবন্ধী তরুণীকে (২০) গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে চার যুবকের বিরুদ্ধে। ৫ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ২৩ বছর বয়সী এক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। ৭ এপ্রিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে ঘরের দরজা ভেঙে এক নববধূকে তুলে নিয়ে রাতভর গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ৯ এপ্রিল ঢাকার ধামরাই উপজেলায় চলন্ত বাসে আবারও এক পোশাকশ্রমিক গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১৩ এপ্রিল ঢাকার সাভার উপজেলায় একটি হোটেলের নারী বাবুর্চিকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist