প্রতীক ইজাজ ও বদরুল আলম মজুমদার

  ১৬ এপ্রিল, ২০১৮

খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন

কেমন হলো দুই দলের মেয়র প্রার্থী

খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ আগেই। এখন চলছে নির্বাচনী মাঠ গোছানোর কাজ। ব্যস্ত দুই দলই। কেন্দ্রের পাশাপাশি চলছে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে কৌশল প্রণয়নের কাজ। দুই প্রার্থীর ব্যক্তি জনপ্রিয়তা যেমন গুরুত্ব পাচ্ছে; তেমনি স্থানীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুকেও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ভোটারদের আস্থায় নিতে চলছে মাঠ পর্যায়ে নানা হিসাব-নিকাশ। জয় পেতে মরিয়া দুই দলই।

এর মধ্যে আওয়ামী লীগ খুলনায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাগেরহাট-৩ আসনের (রামপাল-মোংলা) সাবেক সংসদ সদস্য (মনোনয়নের পর পদত্যাগ করেছেন) তালুকদার আবদুল খালেক এবং গাজীপুরে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছে। আর বিএনপি গাজীপুরে সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি হাসান উদ্দিন সরকার ও খুলনায় নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে মনোনয়ন দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে, মুখ দেখানো মনোনয়ন দেয়নি দল। ভোটের মাঠের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজে খোঁজখবর নিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছেন। দলীয় কোন্দল বা বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে দল-মত নির্বিশেষে জনপ্রিয় প্রার্থীর হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে নৌকা প্রতীক। গতবারের মতো এবার আর হারতে নারাজ ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে, প্রার্থী বদলের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী মাঠে চমক দেখাল বিএনপি। দলের দাবি, ভাবমূর্তি ভালো থাকার পরও বর্তমান দুই মেয়রের বদলে নতুন প্রার্থী দেওয়া হয়েছে কেবল জয় অব্যাহত রাখতেই। ফলে দুই দলই দলীয় প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী।

এমন পরিস্থিতিতে এই দুই সিটিতে এবার নির্বাচন বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ঘুরেফিরে আসছে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক নানা দিক। আলোচনা হচ্ছে প্রার্থীর ভাবমূর্তির বিষয়টিও। স্থানীয় উন্নয়ন ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের পারঙ্গমতা প্রাধান্য পাচ্ছে। উঠে আসছে জাতীয় রাজনীতিতের দলের ভাবমূর্তিও। তবে ভোটারদের মতে, দুই দলের প্রার্থীই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুই সিটিতে চার প্রার্থীরই জনপ্রিয়তা রয়েছে। ফলে নির্বাচনে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবেÑ এমনটাই মনে করছেন সবাই।

প্রার্থীদের জয়ের ব্যাপারে ভীষণ আশাবাদী দুই দলের শীর্ষ নেতারা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, খুব ভেবেচিন্তে, মাঠের জনপ্রিয়তা যাচাই করে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তদারকি করেছেন। মাঠ পর্যায়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। মুখ দেখানো মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ফলে আমরা জয়ের ব্যাপারে ভীষণ আশাবাদী। একইভাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রার্থী বদল করা হয়েছে কেবল জয় আরো নিশ্চিত করতেই। আগের মেয়ররাও জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ভিন্ন স্ট্রাটেজির কারণে এবার প্রার্থী বদল করেছি। আশা করছি, নতুন প্রার্থীরাও গতবারের মতো বড় জয় এনে দেবে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে খুলনা ও গাজীপুরে মেয়র পদে দুই দলের চূড়ান্ত প্রার্থীর পেছনের কারণ জানা গেছে। এর আগে সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ২০১৩ সালের ৬ জুলাই এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের ওই বছরের ১৫ জুন ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে ভোট না হলেও দুই সিটিতেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এবার এখানে নির্বাচন আগামী ১৫ মে।

মুখ দেখানো মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ : দলের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গাজীপুর এবং খুলনায় কয়েক দফা মাঠ জরিপ চালানো হয়। এসব জরিপ পর্যালোচনায় দেখা যায়, গাজীপুরে জাহাঙ্গীর আলম তার প্রতিদ্বন্দ্বী আজমত উল্লাহর থেকে এগিয়ে আছেন। আর খুলনায় অন্যদের তুলনায় তালুকদার আবদুল খালেকের অবস্থান ভালো। জরিপ পর্যালোচনায় দলের হাইকমান্ড জাহাঙ্গীর ও খালেকের পক্ষে মত দেয়। ফলে তাদের দুইজনকেই প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়।

গাজীপুরে কেন জাহাঙ্গীর আলমÑ জানতে চাইলে দলের নেতারা বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুরের তিনটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ফল ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। গাজীপুরের পিরুজালী, ভাওয়াল মির্জাপুর ও ভাওয়াল গড় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভরাডুবি হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের। এই তিনটি ইউপির মধ্যে দুইটিতে জয় পেয়েছে বিএনপি এবং আরেকটি জয়লাভ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী। তিনটি ইউপিতেই আওয়ামী লীগের বড় পরাজয় চিন্তায় ফেলে দেয় দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের। তারা আশঙ্কা করছেন, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই ফল নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শুধু তাই-ই নয়, জেলা নেতৃত্বের কোন্দলের সুযোগ নিয়ে আবারও জয় পেতে পারে বিএনপি। এ অবস্থায় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা আজমত উল্লাহর চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা জাহাঙ্গীর আলমকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার পক্ষপাতি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা।

দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তাই তাকে প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রেখেছে। তাছাড়া আর্থিকভাবেও তিনি প্রতিষ্ঠিত। তৈরি পোশাকশিল্প ও প্যাকেজিংশিল্পের মালিক তিনি। মানুষকে সহযোগিতা করতে পছন্দ করেন। নিজ উদ্যোগে তিনি মেধাবীদের জন্য গাজীপুরে বৃত্তি প্রচলন করেছেন। তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা এসব তথ্য কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। তারা প্রায় সবাই জাহাঙ্গীরের পক্ষেই কাজ করতে চান। সার্বিক দিক ভেবেই তাকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর গতবারের প্রার্থী আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা আজমত উল্লাহ খানকে সন্তুষ্ট রাখতে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হলে তাকে ওই সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেককে চূড়ান্ত করার পক্ষে কারণ দেখিয়ে দলের নেতারা জানান, তালুকদার খালেক মেয়র থাকাকালীন যে সফলতা দেখিয়েছিলেন তা এখন মানুষ উপলব্ধি করছে। বিগত নির্বাচনে তার পরাজয়ের পর এই শহরের উন্নয়ন কাজ মুখথুবড়ে পড়েছে। তালুকদার আবদুল খালেকের প্রয়োজনীয়তা এখন টের পাচ্ছে খুলনার মানুষ। খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় স্থানীয় নেতারা মেয়র পদে তালুকদার আবদুল খালেকের পক্ষেই জোরালো অবস্থান নেন। এসব বিষয় বিবেচনায় তাকেই খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে।

দলীয় সূত্র মতে, স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডে স্বয়ং দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজে খালেককে সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে প্রার্থী হতে বলেন। পরে সে অনুযায়ী পদত্যাগ করেন তালুকদার আবদুল খালেক।

জয়ের লক্ষ্যেই প্রার্থী বদল বিএনপির : ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে বর্তমান সরকার দলের প্রার্থীদের বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে চমক দেখিয়েছিলেন গাজীপুরের মেয়র এম এ মান্নান ও খুলনার নুরুল ইসলাম মনি। তারা দুইজনই আগামী ১৫ মের নির্বাচনে আবারও মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দল প্রার্থী মনোনয়নে এ দুইজনকেই বাদ দিয়ে নতুন প্রার্থী দিয়েছে। তাদের বদলে এবার প্রার্থী হয়েছেন গাজীপুরে হাসান উদ্দিন সরকার ও খুলনায় নুরুল ইসলাম মঞ্জু।

দলীয় সূত্র মতে, শুরু থেকেই গাজীপুর ও খুলনা সিটিতে দলীয় প্রার্থী বদলের চিন্তায় ছিল বিএনপির। আগের প্রার্থীদের অযোগ্যতা থেকে নয়, প্রার্থিতায় বৈচিত্র্য ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ভেবেই নতুন মুখকে প্রার্থী করা হয়েছে।

গাজীপুরের সাবেক মেয়র এম এ মান্নানের পরিবর্তে গাজীপুরের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাসান উদ্দিন সরকারকে শক্তিশালী প্রার্থী মনে করে দল। কারণ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদকে দিয়েই আবার জয় তুলে নিতে চায় বিএনপি। তাছাড়া গাজীপুরের জনপ্রিয় নেতা মান্নানকে বিএনপির প্রার্থী না করার পেছনে দলের অন্যতম যুক্তি হচ্ছে শারীরিক অসুস্থতা বলেও জানান দলের নেতারা।

নতুন প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন বলেন, জয়ের ব্যাপারে আমরা শতভাগ আশাবাদী। হাসান উদ্দিন সরকার একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। তাছাড়া নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। এজন্য সরকার দলের প্রার্থীর বিপক্ষে আমাদের প্রার্থী নিঃসন্দেহে এগিয়ে আছেন।

দলীয় সূত্র মতে, খুলনা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও গতবারের মেয়র মনিরুজ্জামান মনির পরিবর্তে দলের হাইকমান্ড মঞ্জুকে প্রার্থী করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করে দলের স্থানীয় নেতারা। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক মাঠে সহানুভূতি পাওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে এবার। এমন তথ্য থেকেই বিএনপি মনি থেকেও শক্তিশালী প্রার্থীর খোঁজে ছিল। সব শেষ মঞ্জুকে প্রার্থী করার কারণে এখন আওয়ামী শিবিরে হতাশা শুরু হয়েছে। প্রার্থী হিসেবে মঞ্জুর জয়ের রেকর্ডই বেশি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist