শাহ্জাহান সাজু

  ২৪ মার্চ, ২০১৮

ব্যাংক ঋণের ঊর্ধ্বমুখী সুদহারে বিপাকে শিল্পোদ্যোক্তারা

তারল্য সংকটের কারণে আমানত সংগ্রহে উঠে-পড়ে লেগেছে ব্যাংকগুলো। আবার বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে ব্যাংক ঋণে সুদের হারও। ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে কোনো কোনো ব্যাংক ১০ থেকে ১৩ শতাংশেরও বেশি সুদে ঋণ দেওয়া শুরু করেছে। যদিও কয়েক মাস আগে ঋণ বিতরণ করে এক অঙ্কে সুদ পেয়েছে ব্যাংকগুলো। এমন অবস্থায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, সুদের হার বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগ। উচ্চ সুদের ঋণে ব্যবসা করে প্রফিট করা বা বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকা কঠিন হবে। তাই সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তারা।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) মনে করেন সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা খুবই জরুরি। তা না হলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। তাছাড়া সুদের হার বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদের হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। কাজেই এই চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা কঠিন ব্যাপার। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের স্বার্থে সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা খুবই জরুরি বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

তিনি আরো বলেন, এত দিন ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে ছিল। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎতের অপ্রতুলতার জন্য আমরা কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিনিয়োগ করতে পারিনি। এখন গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়ছে অথচ গত কয়েক মাস ধরে ব্যাংক ঋণের সুদের হার দুই অঙ্কে চলে গেছে। তবে বিনিয়োগের স্বার্থে; দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এই ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা খুবই জরুরি বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০টির বেশি ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে সুদের হার বৃদ্ধি করেছে বাকি ব্যাংকগুলো। গত মাস (ফেব্রুয়ারি) থেকে ৫৭টির মধ্যে সবকটি ব্যাংকই দুই অঙ্কে সুদ নিচ্ছে। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, শিল্পের জন্য এককভাবে সব ব্যাংক ব্যবসায়ীদের দুই অঙ্কের সুদে ঋণ দিলেও গড় হিসাবে (কাগজে-কলমে) কিছু ব্যাংকের সুদ হার এখনো দেখাচ্ছে ৯ শতাংশের ঘরে। গত জানুয়ারিতে ১৯টি ব্যাংকের সুদ হার গিয়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে দুই অঙ্কের ঘরে।

বিষয়টি গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে এক কর্মশালায় বক্তারা তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের সুদ ব্যবস্থাপনা লাগামহীন রূপ ধারণ করেছে। এক ধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে ব্যাংক খাতে। একেক ব্যাংক একেক রকমের সুদ নির্ধারণ করছে; যেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশ্বব্যাপী সুদের হার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি রয়েছে; যা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো পদ্ধতি নেই। এতে ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো সুদ বাড়াচ্ছে এবং কমাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহক। বক্তারা বলেছেন, সুদহার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

ওই কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এবং সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেছেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাত বেশকিছু ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। এসব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, ‘সুদসীমা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাংকিং খাতের অবকাঠামো ঠিক করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

এদিকে, ব্যাংকের ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কমিয়ে সম্প্রতি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সাড়ে ৮৩ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ৮৯ টাকা করা হয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রচলিত ধারার ব্যাংকে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৮৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ৮৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়তি ঋণ নির্ধারিত মাত্রায় নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এখন আমানত বাড়িয়ে এডিআর সমন্বয়ের চেষ্টা করছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ঋণপ্রবাহ অনেক বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে। গড়ে প্রতিমাসে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ থেকে ১১ শতাংশ। আমানতের তুলনায় ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় ঋণে সুদের হারও বেড়ে গেছে। গত বছরের নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ। এর আগে অক্টোবরে ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ১৯ দশমিক ৪০ শতাংশ, আগস্টে ১৯ দশমিক ৮৪ ও জুলাইয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জুনে ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

জানা যায়, ২০১৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বেড়েছে ঋণ বিতরণ। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া নভেম্বরে ১৯ দশমিক ০৬, অক্টোবরে ১৮ দশমিক ৬৩, সেপ্টেম্বরে ১৯ দশমিক ৪০, আগস্টে ১৯ দশমিক ৮৪ ও জুলাইয়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ কারণে অধিকাংশ ব্যাংক পড়ে যায় তারল্য সংকটে। পাশাপাশি আমদানি দায় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এদিকে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সীমা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যাংকগুলো। আমানতের সুদ হারও বাড়িয়ে দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। ৩ থেকে ৬ শতাংশ সুদের আমানত এখন ৮ থেকে ১২ শতাংশ সুদে সংগ্রহ করছে ব্যাংকগুলো। আমানতের সুদ বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদ হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, নানা কারণে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বর্তমানে অনেক বেশি। সুদহারের এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist