বিশেষ প্রতিনিধি
সম্মিলিত মুক্তি বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বাঙালি
বীর বাঙালির দৃপ্ত পদচারণায় টালমাটাল ঢাকা। গাজীপুর ও জয়দেবপুরে জ্বলছে সশস্ত্র আন্দোলনের আগুন। ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে। বিক্ষোভে উত্তাল রাজপথ, বিক্ষুব্ধ মানুষ। সকাল থেকে মধ্যরাত, স্রোত নামছে মিছিলের। গগনবিদারী সেøাগান নিয়ে জেগে থাকছে শহর, অলিগলি, পাড়া-মহল্লা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে বাঙালির সাহসের, দৃপ্ত শপথের পাদপীঠ। বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র প্রতিরোধ রূপ নেয় যূথবদ্ধ শক্তিতে। সম্মিলিত মুক্তি বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বাঙালি।
বাঙালির অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিন আজ ২০ মার্চ। একাত্তরের এদিন হঠাৎ করেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণে দেশের মানুষের প্রতি যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যতই বাধা আসুক বাংলার মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম চলবেই। কিছুতেই এ আন্দোলনে ভাটা পড়তে দেওয়া হবে না।
রাতে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত।
সকালে কঠোর সামরিক প্রহরা-পরিবেষ্টিত রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে অনুষ্ঠিত হয় মুজিব-ইয়াহিয়া চতুর্থ দফা বৈঠক। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ছয় শীর্ষ স্থানীয় সহকর্মীও অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু জয়দেবপুরে পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতি ইয়াহিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঘটনার তদন্তের আশ্বাস দেন ইয়াহিয়া। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হন বঙ্গবন্ধু। উপস্থিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। সময় এলে সবকিছু বলব।
আগুনঝরা একাত্তরের এদিন সকাল থেকেই ঢাকায় ঢল নামে মিছিলের। দলে দলে পথে নামে তেজোদীপ্ত মানুষ। দেখা দেয় চরম উত্তেজনা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সারাদিনই চলে সভা, সমাবেশ, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সুসজ্জিত গণবাহিনীর মতো সামরিক কায়দায় বন্দুক উঁচিয়ে রাজপথে মিছিল করে ছাত্র ইউনিয়ন। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ হাত নেড়ে, সেøাগানে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রকাশ করে তাদের সমর্থন। যথারীতি বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত। বাড়ির ছাদে-বারান্দায় উড়তে থাকে কালো পতাকা। গাড়ির সামনে ওড়ে স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা।
জয়দেবপুরের ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয় পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য শেখ মোহাম্মদ মোবারক হোসেন তাকে দেওয়া ‘তঘমা-ই-পাকিস্তান’ খেতাব বর্জন করেন।
কাউন্সিল মুসলিম লীগপ্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মুফতি মাহমুদ পৃথক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশ করেন নৌবাহিনীর সাবেক সৈনিকরা। সমাবেশ থেকে সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈন্যদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বক্তারা বাঙালি সৈন্যদের শুধু পূর্ব পাকিস্তানে রাখা এবং অবিলম্বের পূর্ব পাকিস্তান থেকে অবাঙালি সৈন্যদের অপসারণের দাবি জানান। সমাবেশ শেষে বাঙালি নৌ-সেনারা কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান ও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দানের প্রতিশ্রুতি দেন আবেগাপ্লুত নৌ-সেনারা।
অন্যদিকে, করাচিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে ২১ মার্চ ঢাকা আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ’৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে বসে শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কিছুতেই ৬ দফাভিত্তিক এ পরিকল্পনা মানা হবে না। এর আগে সকালে করাচি থেকে ঢাকায় এলেন সুপ্রিমকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌঁসুলি এ কে রোহি।
"