জুবায়ের চৌধুরী

  ২০ মার্চ, ২০১৮

স্বজনদের চোখে জল বুকচাপা আর্তনাদ

স্বামী নুরুজ্জামান বাবুর ছবি বুকে জড়িয়ে আর্মি স্টেডিয়ামে বসে আছেন সুলতানা আক্তার। সঙ্গে আছেন ১০ বছরের ছেলে হামিম, ননদসহ স্বজনদের অনেকেই। সবার চোখেই পানি। আর বুকচাপা আর্তনাদই বলে দিচ্ছে কষ্টের তীব্রতা। নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ২৬ বাংলাদেশির একজন নুরুজ্জামান। তিনি রানার অটোমোবাইলস লিমিটেডের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোরম্যান ছিলেন। শুধু নুরুজ্জামানের স্বজনরাই নন, নিহত সবার স্বজনরাই গতকাল সোমবার মরদেহ নিতে এসেছিলেন রাজধানীর বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। কেউ গালে হাত দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে, কেউবা রুমাল আর আঁচলে চোখের জল মুছে কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চোখের জল মুছা গেলেও তাদের বুকচাপা আর্তনাদ সেই কষ্টের তীব্রতাকে লুকানো গেল না কিছুতেই!

গতকাল বিকেলে আর্মি স্টেডিয়ামে যখন স্বজনদের লাশ নিতে মাইকে ঘোষণা শুরু হলো, তখন ‘মা ও মা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট পৃথুলা রশীদের মা রাফেজা বেগম। তার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে ঝরেছে অশ্রুধারা। তার পাশে বসে থাকা পৃথুলার বন্ধু পাইলট সামিয়া বন্ধুর মাকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে নিজেও কেঁদে ওঠেন। মরদেহ স্বজনদের বুঝিয়ে দিতে পৃথুলার নাম মাইকে ডাকলে এ হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পৃথুলার মায়ের পাশে তার নানু ও ছোট খালা বসেছিলেন। তারাও হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।

আহত শরীরেই ভাই ও ভাতিজিকে বিদায় দিতে আসেন মেহেদী : আনন্দভ্রমণে বেরিয়েছিলেন সবাই। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল স্বপ্নের নেপাল। এর আগে কখনো বিদেশেই যাননি তিনি। হয়ে ওঠেনি বিমান ভ্রমণও। তাই স্ত্রী ও ভাইয়ের পরিবারসহ পাঁচজন মিলে যাচ্ছিলেন নেপালে। কিন্তু পরিণতি এমন হবে ভাবেননি মেহেদী হাসান। কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই বলছিলেন কথাগুলো। গতকাল ভাই ও ভাতিজিকে শেষ বিদায় দিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে আর্মি স্টেডিয়ামে এসেছিলেন মেহেদী। এ সময় তার হাতে স্যালাইন দেওয়ার ক্যানোলা আর ঘাড়ে ছিল আলাদা সাপোর্ট।

গত ১২ মার্চ নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ৪৯ জন। এর মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশি। ওই ফ্লাইটে ছিলেন মেহেদী হাসান, তার স্ত্রী সৈয়দ কামরুন্নাহার স্বর্ণা, ভাই ফারুক হোসেন প্রিয়ক, ভাইয়ের স্ত্রী আলামুন নাহার অ্যানি ও ভাইয়ের ছোট্ট মেয়ে তামারা প্রিয়ন্ময়ী। দুর্ঘটনায় নিহত হন, প্রিয়ক ও তার মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী। বাকিরা আহত। নেপালে চিকিৎসার পর দেশে এসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তারা। আহত শরীর নিয়েই গতকাল ভাই ও তার নিহত সন্তানকে শেষ বিদায়ে আর্মি স্টেডিয়ামে আসেন মেহেদী হাসান।

মুখ ঢেকে বারবার কাঁদছিলেন তিনি। কান্নাভেজা কণ্ঠেই জানান, উড়োজাহাজের পেছনের দিকের পাঁচটি আসনে পাশাপাশি বসেছিলেন সবাই। তিনি বসেছিলেন জানালার পাশে। বিধ্বস্ত হওয়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে অবতরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। সবাইকে সিট বেল্ট বাঁধতে বলা হয়। সবাই সিট বেল্ট বাঁধেন। ঘোষণা দেওয়ার পরপরই মেহেদী জানালা দিয়ে দেখেন ল্যান্ডিং গিয়ার বের হয়েছে। উড়োজাহাজটি অনেক নিচু দিয়েই উড়ছিল বেশ কয়েক মিনিট ধরে। সবই স্বাভাবিক ছিল। প্রথমে ভূমি স্পর্শ করে ছিটকে পড়ে উড়োজাহাজটি। মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার। মেহেদী ও তার স্ত্রী সামনের ভাঙা অংশ দিয়ে কোনোভাবে নামতে পারেন। মেহেদী নেমেই নিচে কয়েকজনকে পড়ে থাকতে দেখেন। পরে উদ্ধারকারীরা এসে তাদের নিয়ে যান।

এর আগে গতকাল সকালে কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ২৩ বাংলাদেশির প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নিহতদের স্বজন ছাড়াও সাংবাদিক, দূতাবাস ও এয়ারলাইনসের কর্মকর্তারা জানাজায় শরিক হন। এ সময় নেপাল সরকারের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। তারও আগে ভোরে মরদেহগুলো বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে নেপাল কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকেলে আর্মি স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় জানাজা শেষে ২৩টি মরদেহ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর নিহতের স্বজনরা নানা প্রক্রিয়া শেষে কফিন নিয়ে রওনা হন যার যার ঠিকানায়। নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রিয়জনের দাফন সম্পন্ন করবেন তারা। এদিকে, নেপালের দুর্ঘটনায় নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে যে তিনজনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি তারা হলেনÑ আলিফউজ্জামান, নজরুল ইসলাম ও পিয়াস রায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist