প্রতীক ইজাজ

  ১৭ মার্চ, ২০১৮

নেপালে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনা

কোন পথে তদন্ত কবে প্রতিবেদন

নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশের উড়োজাহাজের স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৫১ জনের মর্মন্তুদ মৃত্যু শোক কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কেউ। নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশেরই ২৬ জন। এতগুলো মানুষের এমন করুণ মৃত্যুতে এখনো শোকাচ্ছন্ন গোটা দেশ। নিহত মানুষগুলো এমনভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন যে, তাদের বেশিরভাগকেই শনাক্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্ভর করতে হচ্ছে ডিএনএ টেস্টের ওপর। দেরি হচ্ছে স্বজনের মরদেহ পেতে। নেপালের হাসপাতালের মর্গে থাকা ওই মরদেহ ঘিরে তাই স্বজনদের আহাজারিও যেন আর শেষ হতে চায় না। থামছে না বেঁচে থাকা স্বজনদের চোখের জল। অগ্নিদগ্ধ চিকিৎসাধীন মানুষগুলোর বেঁচে থাকার আর্তি আরো বেশি বেদনাবিধুর করে তুলেছে চারপাশ। সর্বত্র এখন কেবলই কান্না, কেবলই দুঃখ। এক সঙ্গে এতগুলো মানুষের এমন করুণ মৃত্যুর শোক যেন বইতে পারছে না দেশ।

এত মৃত্যু এবার বিশেষভাবে শোকাহত করেছে দেশকে। নিহতের অধিকাংশই নানাজনের সঙ্গে নানাভাবে পরিচিত ও জনপ্রিয় সৃজনশীল মানুষ। নানা বন্ধনে বাধা একে অন্যের সঙ্গে। কেউ আত্মীয়, বন্ধু, কেউ বা সহকর্মী। কাজে, আড্ডায়, রাজনীতি, আন্দোলনে কিংবা পেশাগত কাজে নিহতদের সঙ্গে নানা স্মৃতি সবার। রয়েছে নানা মুহূর্তের আনন্দযাপন

নানা ছবি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে উদ্ভাসিত সেসব স্মৃতি আরো বেশি বেদনাবিধুর করে তুলেছে দেশকে; ব্যক্তি থেকে সমাজের নানা স্তরে। নানাভাবে স্মরণ করা হচ্ছে তাদের। কর্মক্ষেত্রে, দূতাবাসে, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চর্চা কেন্দ্রে খোলা হয়েছে শোকবই। স্মৃতি লিখতে গিয়ে চোখের জলে ভিজছে কাগজ।

কিন্তু কেন? কাদের গাফিলতিতে এমন মর্মন্তুদ দুর্ঘটনা? কোন ত্রুটিতে প্রাণ গেল এতগুলো মানুষের? প্রশ্ন উঠছে দুর্ঘটনা এড়াতে আগেভাগেই উভয় দেশের বিমান কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি নিয়েও। গত সোমবার দুর্ঘটনার পর থেকেই এমন প্রশ্নও উঠছে সর্বত্র। জোরালো হচ্ছে দুর্ঘটনার তদন্তের দাবি। এ নিয়ে কথা বলছেন দেশ-বিদেশের বিমান বিশেষজ্ঞরা। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। সবাই উদগ্রীব দুর্ঘটনার মূল কারণ জানতে। আলোচনা হচ্ছে তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। কোন পথে ও কিভাবে এমন দুর্ঘটনার তদন্ত করা যায়Ñ সে পথ যেমন বাতলে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা; তেমনি ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে তদন্তের সময়সীমা ও পরিধি নিয়েও। এমনকি নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ হওয়া নিয়েও তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের দুর্ঘটনার তদন্তে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বেশি সময় লাগে। তবে একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই তদন্ত শেষ করা সম্ভব ও উচিত। কেননা এ পর্যন্ত দেশে বিমান ও হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ৮২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সাধারণ যাত্রী ৫৫ জন এবং কেবিন ও ককপিট ক্রু রয়েছেন ২৭ জন। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত করে কারণ বের করা হলেও এসব অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা রোধে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এমনকি এর আগে ইউএস-বাংলার নেপালে বিধ্বস্ত উড়োজাহাজটি দেশের ভেতর আরো দুবার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল। কিন্তু কোনোবারই দুর্ঘটনার তদন্ত করা হয়নি। এমনকি এই সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

ইতোমধ্যেই এই ঘটনা তদন্ত শুরু করেছে নেপাল। দুর্ঘটনার দুদিন পর গত বুধবার নেপাল সরকার গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজও শুরু করেছে। তদন্ত কমিটি বলছে, আট মাসের আগে তাদের পক্ষে রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। একইভাবে তদন্তে এক বছরের মতো লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত পরিচালনার জন্যই এমন সময় প্রয়োজন হয়। অতীতের বিভিন্ন দুর্ঘটনার তদন্তেও এমন সময় লেগেছে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত পরিচালনা করা হবে। মূলত ঘটনাটির তদন্ত করবে নেপাল। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে আমাদের টিম। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।

তবে বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের আসল রহস্য আদৌ উন্মোচন হবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কেননা দুর্ঘটনার জন্য ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস পরস্পরকে দূষছে। ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি কেন দুর্ঘটনায় পড়ল, তা এখনো অস্পষ্ট। কাঠমান্ডু এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বলছে, পাইলটের ভুলে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, দুর্ঘটনার জন্য ত্রিভুবনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের গাফিলতি দায়ী। দুই পক্ষের এমন টানাপড়েনের মধ্যে তদন্ত কমিটি কিভাবে কাজ করে, সেটি দেখার বিষয়।

তদন্তে কোন বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে- জানতে চাইলে নেপাল সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির সঙ্গে কাজ করছেন বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশনের এমন সূত্রগুলো জানায়, মূলত ইউএস-বাংলার বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের ‘যান্ত্রিক ত্রুটির ক্লু’ সামনে রেখে কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি রানওয়ের সংকেত নিয়ে টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের ‘রেডিও টেলিফোনি’র (আরটি) ভুল বোঝাবুঝি, পাইলটের ভুল ‘রিড ব্যাক’, টাওয়ারের ভুল সংশোধন না করা ও ‘ল্যান্ডিং কন্ট্রোল’ কার হাতে ছিল- এগুলোও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তদন্ত কমিটি মনে করছে, উড়োজাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। সে জন্যই পাইলট দ্রুত বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের সংকেত অমান্য করে দ্রুত রানওয়ের ‘টু জিরো (উত্তর)’ প্রান্ত দিয়ে অবতরণের চেষ্টা করেছেন।

তদন্ত কমিটির এমন তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবতরণের সময় ‘এয়ারক্রাফটের ল্যান্ডিং কন্ট্রোল’ সাধারণত কোপাইলট অর্থাৎ ফার্স্ট অফিসারের হাতে থাকে। সে হিসেবে মূল পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ‘আরটি’ (পাইলটের সঙ্গে বিমানবন্দর টাওয়ারে যোগাযোগ) করেছেন, আর ককপিটের ডান পাশে বসে ‘ল্যান্ডিং কন্ট্রোল’ করেছেন কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ। এমন হতে পারে অভিজ্ঞতা কম থাকায় ও রানওয়েতে আইএলএস (ইনস্ট্র-মেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম) না থাকায় কোপাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারেন। যে কারণে রানওয়ে খুঁজে পাওয়ার আগেই উড়োজাহাজটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পার্শ্ববর্তী খেলার মাঠে বিধ্বস্ত হয়।

‘তবে এসব তথ্য নিশ্চিত করতে এয়ারক্রাফটের ফ্লাইট ডাটা মনিটর (এফডিএম) ও রেডিও টেলিফোনি’র তথ্য খুঁজতে উড়োজাহাজের ‘ব্ল্যাক বক্স’ এর ওপর নির্ভর করতে হবে’- বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ব্ল্যাক বক্সটি পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে বলে দেশের বেসামরিক বিমানমন্ত্রী জানিয়েছেন। ফ্লাইট উড্ডয়ন থেকে শুরু করে দুর্ঘটনার আদ্যোপান্ত তথ্য এই বক্সেই সংরক্ষিত আছে।

সাধারণত কিভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় এমন দুর্ঘটনার তদন্ত করা হয়- জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়া বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের পাইলটের মধ্যকার কথোপকথন ছাড়াও নানা দিক খুঁটিয়ে দেখা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের এক্সিকিউটিভ পাইলট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এবং বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ ভি কে ভাল্লাহ বলেছেন, দুর্ঘটনার পর প্রধানত দুটো দিক দেখা হয়Ñ যন্ত্র বিকল হয়েছিল, নাকি মানুষের ভুল হয়েছিল। সাধারণত যন্ত্রের কারণেই অধিকাংশ বিমান দুর্ঘটনা হয়। তদন্ত শুরু করা হয় বিমান টেক-অফ করারও অনেক আগের ঘটনাপ্রবাহ থেকে। ফ্লাইটের আগে পাইলটকে কী ব্রিফ করা হয়েছিল, আগের দিনগুলোতে ওই বিমানে কোনো ত্রুটি কখনো ধরা পড়েছিল কি না। ধরা পড়লে সেটা শোধরানো হয়েছিল কি না। বিমান ওভারলোড ছিল কি না ইত্যাদি বহু কিছু। সংশ্লিষ্ট বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়।

‘কিন্তু তদন্তের প্রধান দুটো সূত্র- ব্ল্যাক বক্স এবং ফ্লাই ডেটা রেকর্ডার (এফডিআর)’- বলেন বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ইউএস-বাংলা বিধ্বস্ত ফ্লাইটের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রই উদ্ধার করা হয়েছে। এই দুটো যন্ত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বিমান দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করা হয়। তবে ব্ল্যাক বক্স থেকে তথ্য বের করার সক্ষমতা অধিকাংশ দেশের এখনো নেই। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাউ) সহায়তা নিয়ে থাকে। চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বিমান চলাচল সংস্থা এফএএ এসব ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। তবে দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়ের প্রধান দায়িত্ব যে দেশে দুর্ঘটনা ঘটে এবং যে দেশের বিমান সেই দুই দেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist