প্রতীক ইজাজ

  ০৭ মার্চ, ২০১৮

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ

আজ বাঙালির সেই কাক্সিক্ষত ৭ মার্চ। বাঙালির গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বলতম ইতিহাস। ’৭১-এর এ দিনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে ঘোষণা করেছিলেন বাঙালির মুক্তির মূলমন্ত্র। অকুণ্ঠচিত্তে ডাক দিয়েছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সংশয়ে থাকা বাঙালির চোখে বঙ্গবন্ধু জ্বালিয়ে দিলেন স্বাধীনতার অমর জ্যোতি। সেদিন দুপুরের অনেক আগেই রেসকোর্স রূপ নেয় জনসমুদ্রে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সমাবেশে যোগ দেয় লাখ লাখ মানুষ। তাদের মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ে চারপাশ। হাতে বাঁশের লাঠি, বাতাসে উড়ছে লাল সূর্যের পতাকা। হাত উঠছে, হাত নামছে। কেঁপে উঠছে জনসমুদ্র, শহর, গোটা পূর্ব পাকিস্তান। বিকেল সোয়া ৩টায় সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি ও কালো কোট পরে মঞ্চে এলেন বঙ্গবন্ধু। করতালি ও ‘জয় বাংলা’ সেøাগানের মধ্য দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল বীর জনতা।

বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানান, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’

বক্তৃতাকালে জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্লোগান- ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।

দীর্ঘ ৪৭ বছর পর সেই ভাষণ এখন বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনীতিতে এক কালজয়ী উপাখ্যান। গত বছরের অক্টোবরের শেষে জাতিসংঘের ইউনেসকো ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দেয় ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে। ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে (এমওডব্লিউ)’ বিশ্বের সংগৃহীত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথির সঙ্গে স্থান করে নিয়েছে ৭ মার্চের ভাষণও। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থে আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই গ্রন্থে রয়েছে গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের ভাষণ (৪৩১ খ্রি.পূর্ব) থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), আব্রাহাম লিংকন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভøাদিমির লেনিন (রাশিয়া), মাও সেতুং (গণচীন) প্রমুখ নেতাদের বিখ্যাত ভাষণ।

এক হাজার ১০৫টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত মাত্র ১৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণ। অথচ জগদ্বিখ্যাত। ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণই অলিখিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। অসাধারণ-এর বক্তব্য। যেমন সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিযুক্ত; তেমনি তির্যক, তীক্ষè ও দিক-নির্দেশনাপূর্ণ। অপূর্ব শব্দশৈলী, বাক্যবিন্যাস ও বাচনভঙ্গি। একান্তই আপন, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যম-িত। ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালিদের অবস্থা সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। তাই এই ভাষণ শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্ব মানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ।

একাত্তরের এই দিন রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতারের। সে উপলক্ষে প্রচার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু মাত্র কয়েকটি দেশাত্মবোধক সংগীত ও আমার সোনার বাংলা গানটি প্রচারের পর হঠাৎ করেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় অধিবেশনের। প্রতিবাদে কাজ বর্জন করে বেতার ছেড়ে পথে নেমে আসেন বাঙালি কর্মচারীরা। বিকেল থেকে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সব অনুষ্ঠান প্রচার। নিরূপায় সামরিক সরকার বাধ্য হয়েই গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দেয়। পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েই চালু হয় ঢাকা বেতার।

এর আগে সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ৩২ নম্বরে সাক্ষাৎ করেন। স্বল্প সময়ের সে গোপন বৈঠকে রাষ্ট্রদূত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, পূর্ব পাকিস্তানে ঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।

বিকেল পৌনে ৪টায় পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর টিক্কা খান ঢাকায় এলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ৬ মার্চের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বেতার ভাষণের প্রতিবাদে আজ এক বিবৃতি দেন বঙ্গবন্ধু। রাতে পৃথক আরেকটি বিবৃতিতে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য ১০ দফা দাবি পেশ করেন তিনি।

দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বেলা ২টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা। সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist