নিজস্ব প্রতিবেদক
মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আর নেই
মুক্তিযোদ্ধা, ভাস্কর ও অধিকারকর্মী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আর নেই। কিডনি ও হৃদরোগের জটিলতা নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার দুপুরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত এই মুক্তিযোদ্ধার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী জানান, গত বছরের নভেম্বরে বাথরুমে পড়ে গোড়ালিতে চোট পান তার মা। হাসপাতালে ভর্তি করার পর হার্ট অ্যাটাক হলে তার হৃদযন্ত্রে স্থায়ীভাবে পেসমেকার বসাতে হয়। এরপর ডিসেম্বরের শেষে আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ভর্তি করা হয় ল্যাবএইড হাসপাতালে। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
ফুলেশ্বরী জানান, কয়েক দিন আগে তার মায়ের গোড়ালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু রক্তচাপ ঠিক থাকছিল না। অবস্থা খারাপ হলে মঙ্গলবার সকালে তাকে ল্যাবএইডের সিসিইউতে নেওয়া হয়। বেলা পৌনে ১টার দিকে সেখানেই তার মৃত্যু হয় বলে ল্যাবএইড হাসপাতালের কর্মকর্তা সাইফুর লেনিন জানান। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যুর খবরে দেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। শিল্পী, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধি এবং অধিকারকর্মীদের অনেকেই ছুটে যান হাসপাতালে।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার গতকাল হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, বিকেলে প্রিয়ভাষিণীর মরদেহ বসুন্ধরা পিংক সিটিতে তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তাকে গোসল করিয়ে রাতে মরদেহ রাখা হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালের হিমঘরে।
পরিবারের পক্ষে কবি মো. সামাদ বলেন, ‘প্রিয়ভাষিণীর ছেলে কাজী মহম্মদ শাকের তূর্য আগামীকাল (বুধবার) অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরবেন। তারপর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে এক ঘণ্টা কফিন রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ওইদিন জোহরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হবে। পরে তাকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।’
আগামী ১০ মার্চ বিকেল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই মুক্তিযোদ্ধার জন্য নাগরিক শোকসভার আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।
১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্ম। তার নানা অ্যাডভোকেট আবদুল হাকিম ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সরকারের সময় স্পিকার হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বর্বর সেনা বাহিনী নির্যাতন করে এই বীর নারীকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। তার আগে ২০১০ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার।
যুদ্ধদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ২০১৫ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি খুলনা ছিলাম। অক্টোবরের শেষের দিকে আমাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়, ৩২ ঘণ্টা আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল। এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা তারা করেনি। আমার জীবনে সে এক দুঃসহ স্মৃতি।’
ছয় সন্তানের জননী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর পুরো জীবন কেটেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৭ সাল থেকে দুই দশকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন, যার শুরু হয়েছিল স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে। পরে মন দেন শিল্পের সাধনায়; ঝরা পাতা, শুকনো ডাল, গাছের গুঁড়ি দিয়ে তার তৈরি গৃহসজ্জার উপকরণ ও শিল্পকর্ম তাকে ধীরে ধীরে করে তোলে ভাস্কর।
২০১৪ সালে একুশের বইমেলায় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘নিন্দিত নন্দন’ প্রকাশিত হয়। তার তিন ছেলে কারু তিতাস, কাজী মহম্মদ নাসের ও কাজী মহম্মদ শাকের তূর্য; আর রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী, রতেœশ্বরী প্রিয়দর্শিনী, ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী তার তিন মেয়ে।
মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার এক শোকবার্তায় উপাচার্য বলেন, ‘ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি মর্মাহত। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সৃজনশীল সংগ্রামী মানুষের মৃত্যুতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হলো।’
"