কাজী আবুল মনসুর, আরব আমিরাত থেকে ফিরে

  ০৬ মার্চ, ২০১৮

সরেজমিন আরব আমিরাত ৪

বিস্ময়ভরা বুর্জ খলিফা, গ্র্যান্ড মসজিদ ও মিরাকেল গার্ডেন

আরব আমিরাতের সবচেয়ে ধনী দেশ আবুধাবি। দেশটির রাজধানীর মানুষজন বলে আবুধাবির টাকায় নাকি অন্যরা চলে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএইর আয়তন ৮৩ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার। আবুধাবি হচ্ছে দেশটির মোট আয়তনের ৮৬ শতাংশ। এরপর রয়েছে দুবাইয়ের স্থান ৫ শতাংশ। বাকিগুলো আয়তনের দিক থেকে অতি ক্ষুদ্র। আরব আমিরাত মূলত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়েই গঠিত। দুবাই, আজমান, ফুজাইরাহ, রাস আল কায়মা, শারজাহ ও উম্মুল খুওয়াইন। এগুলোকে কেউ বলে রাজ্য, কেউ বলে প্রদেশ। আসলে এগুলো এক একটি রাষ্ট্র। কারণ তাদের প্রশাসন ও শাসনব্যবস্থা আলাদা। তারা যৌথভাবে ফেডারেল সুপ্রিম কাউন্সিল গঠন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। তেলসমৃদ্ধ বলে আবুধাবির অবস্থান অন্য শরিক দেশের চেয়ে উঁচুতে। বংশপরম্পরায় বা উত্তরাধিকার সূত্রে আবুধাবির রাজপরিবারই যুক্তরাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকে। আমিরাতের তেল মজুদ ক্ষমতা বিশে^ সপ্তম এবং গ্যাসের মজুদ বিশে^ ১৭তম। আবুধাবি আমিরাতের রাজধানী হিসেবে আধিপত্য বজায় রাখে। আবুধাবি ছাড়া অন্য রাষ্ট্রগুলো কার্যত তেমন ক্ষমতা রাখে না। আরব আমিরাতে মোট জনসংখ্যা এক কোটি। মজার বিষয় হচ্ছে, মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশই অভিবাসী! এর মধ্যে আমিরাতি মাত্র ১৯ শতাংশ। জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ।

আবুধাবি এসে বুঝলাম সুন্দর পরিপাটি এ রাজ্যে অসংখ্য বাংলাদেশি। বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের আধিপত্য। রাঙ্গুনিয়ার ব্যবসায়ী জসিম ৪৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে আজমান থেকে আবুধাবি নিয়ে আসেন। এখানে নেমে নজরকাড়া সব ভবন দেখে বোঝা কি বিশাল অর্থবিত্তের মালিক এরা। বাঙালি হোটেলে দেশের খাওয়া। খেতে বসেই চতুর্দিক থেকে চট্টগ্রামের ভাষায় কথার কলকাকলি। যেই সবার মুখে খৈ ফুটছে। ‘অড়া বারির খনঅ খবর পাইয়ুছ না... চিটাগাং অত তুন কমিশনার ভাই আইস্যি। এমন সব কথা। বুঝলাম এলাকাটিতে চট্টগ্রামের লোকজনই সবচেয়ে বেশি। পথ চলতে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলা লোকজনের অভাব নেই। বিশেষ করে বিভিন্ন বড় বড় শপিং মলের বিক্রয়কর্মী হিসেবে অসংখ্য বাংলাদেশি নজরে পড়ার মতো। চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে গেছি আর সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে অনেকে মনের কথা খুলে বলতে চান। জানতে চান দেশের খবর। কোথায় কোথায় যাওয়া যায় তার জন্য পরামর্শসহ তাদের সঙ্গে দু-এক দিন কাটানোর অনুরোধ। দেশের রাজনীতির হালহকিকত জানতে চান। অনেকে জানতে চান এখন দেশে গেলে সমস্যায় পড়বেন কি না। এদের কেউ আওয়ামী লীগ আর কেউ বিএনপি। তবে যে দলই করুক না কেন, সবাই দেশের ভালো চান। মঙ্গল চান।

দেশের কাস্টমসে হয়রানি আর নিজেদের সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে সবচেয়ে চিন্তিত থাকেন তারা। এখানে অফিসের নিয়মকানুন খুবই কড়া। কড়ায়-গন্ডায় কাজ আদায় করে নেন। ফাঁকির কোনো অবকাশ নেই। সন্ধ্যা হলে তারা আবুধাবির মূল কেন্দ্রে জড়ো হন। নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলেন। কারো কারো দোকানে টেলিভিশন চলে। টেলিভিশনের সংবাদের প্রতি আগ্রহটা সবচেয়ে বেশি। নিজের দেশের নতুন কাউকে পেলে ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্নÑকবে আমাদের দেশটি এ দেশের মতো হবে। বিদেশে আসলে নিজের দেশের দুর্বলতাগুলো ধরা পড়ে। কত পদ্ধতিগতভাবে একটি দেশ নিজেদের সমৃদ্ধ করে, তা আবুধাবিতে এসে আরো বুঝলাম।

আবুধাবির সবচেয়ে বিস্ময়ের বস্তু হলো শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ। সুন্নি মতাদর্শী বলে খ্যাত এ মসজিদ এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যা দেখলে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। প্রায় সাড়ে ৫০০ মিলিয়ন দেরহামে নির্মিত এ মসজিদে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারে। ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে বানানো হয়েছে মসজিদের অনেক স্তম্ভ। আবুধাবির মূল কেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। আবুধাবির পাশ দিয়ে বয়ে চলা পারস্য উপসাগরের একপাশ ঘিরে বানানো হয়েছে ধনী শেখদের অনেক বাড়িঘর। অনেকটা নদী শাসন করে বানানো হয়েছে সৈকত। সৈকতকে তারা বলে ‘কর্নিশ’। অনন্য সুন্দর এ কর্নিশ ঘিরে পর্যটনকে তারা উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছে।

দিনভর আবুধাবিতে ঘোরাঘুরি করে দুবাইয়ের পথে যাত্রা। যাত্রাপথে দেখা যায় মরুভূমির মাঝ বরাবর বিরাট প্রশস্ত রাস্তা। পাশে ধু ধু মরুভূমি। অনেকাংশে তৈরি করা হয়েছে ফ্লাইওভার। সন্ধ্যানাগাদ পৌঁছতে হবে দুবাইয়ের কেন্দ্রে। রাতে সেখানকার বুর্জ খলিফা না দেখলে ভ্রমণ মাটি। বিলাসী আরবরা যে আকাশ ছুতে চান তা দুবাই এসে বুঝলাম। তাদের সে আশা পূরণ করেছে ‘বুর্জ খলিফা’। ওপরের দিকে আধা মাইল লম্বা এ বুর্জ খলিফা দেখতেই বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। বর্তমানে বিশে^র সবচেয়ে উঁচু ভবন। যার উচ্চতা ১৬৩ তলা। বিস্ময়কর এর নির্মাণশৈলী। আর এক বিস্ময়কর নির্মাণ হচ্ছে দুবাইয়ের ‘মিরাকেল গার্ডেন’। মিরাকেল গার্ডেন আসলেই মিরাকেল।

বুর্জ খলিফা ও মিরাকেল গার্ডেন সারা বিশে^র পর্যটকদের টানে। মিরাকেল গার্ডেন আর বুর্জ খলিফা দুবাইকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। প্রতিদিন এ দুটি পর্যটন কেন্দ্র দেখতে বিশে^র হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে। বুর্জ খলিফা বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। রাতে বুর্জ খলিফার সৌন্দর্য দেখার কথা আগেভাগেই শুনছিলাম। বুর্জ খলিফা শুধু ভবন নয়, এই ভবন ঘিরে অসাধারণ সব আয়োজন ছিল নজরে পড়ার মতো। বিশেষ করে বুর্জ খলিফাকে সামনে রেখে জলের নৃত্য অসাধারণ। এ নৃত্য দেখার জন্য আগেভাগেই ফোয়ারার পাশে জায়গা রাখতে হয়। তা না হলে দূর থেকে দেখলে আনন্দ পাওয়া যায় না। ফোয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিটের আতশবাজি আর জলের নৃত্য পর্যটকদের মোহগ্রস্ত করে রাখে।

বুর্জ খলিফার উচ্চতা ১৬৩ তলা। ২০০৬ সালের ৬ জানুয়ারি এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালের মধ্যে শেষ হয় এর বাইরের কাঠামো নির্মাণের কাজ। ২০১০ সালে এটি পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। এ ভবন নির্মাণের আগে তাইওয়ানের ১০১ তলা ভবনটি ছিল বিশে^র সবচেয়ে উঁচু ভবন। ২০১০ সালে ভবনটি খুলে দেওয়া হয়। নাম ছিল দুবাই টাওয়ার। অনেকটা জাপানের টোকিও টাওয়ার বা ফ্রান্সের প্যারিস টাওয়ারের মতোন। কিন্তু আরব আমিরাতের শাসক খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে সম্মান জানাতে গিয়ে নাম পাল্টে রাখা হয় ‘বুর্জ খলিফা’। এ ভবন তৈরি করতে দুবাইয়ের প্রশাসন আবুধাবিসহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ঋণ নিয়েছিল। পরে তা শোধ করা হয়। এ ভবনে রয়েছে সেভেন স্টার মানের হোটেল। এ বুর্জ খলিফা একটি গগনচুম্বী অট্টালিকা। বলা হয়ে থাকে এটি পৃথিবীর অনন্য সৃষ্টি। দুই হাজার ৭১৭ ফুটের ভবনটি বানাতে খরচ হয়েছে এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ১৬৩ তলার ভবনটিতে মসজিদ, দর্শনার্থীদের কক্ষ, থাকার হোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এখানে স্থাপন করা লিফটের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ মাইল। মাত্র ছয় বছরে এ বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বাইরের ফোয়ারা নির্মাণে ব্যয় প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড। এ বুর্জ খলিফার ভেতরে রয়েছে ৫৭টি এলিভেটর ও আটটি অ্যাস্কলেটর। প্রায় ৪০ লাখ বর্গমিটারের এ ভবনে ৪০৩টি স্যুটের একটি বিলাসবহুল হোটেল রয়েছে। এটি নির্মাণে ১২ হাজার শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করেছেন।

দুবাইয়ের আর একটি বিস্ময় হচ্ছে মিরাকেল গার্ডেন। ২০১৩ সালে ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগানখ্যাত এ মিরাকেল গার্ডেনটির উদ্বোধন করা হয়। ৭২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এ বাগানে ৪৫ মিলিয়নেরও বেশি ফুল রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, অনেক নতুন ফুলের জম্মও এখানে। যা বিশে^ও কোথাও নেই। বাড়ি, গাড়ি থেকে শুরু করে হার্ট, বিমান, ইগলু, পিরামিড, পশুপাখিসহ অনেক কিছুর বিভিন্ন আকৃতি বানানো হয়েছে ফুল দিয়েই। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফুল লাগানো হয় এ বাগানে। তবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দর্শনার্থীরা বাগানটি দেখার সুযোগ মেলে। বাকি গরমের সময় এটি বন্ধ থাকে। এটার পাশাপাশি ২০১৫ সালে দুবাইয়ে বানানো হয়েছে প্রজাপতি পার্ক। এ পার্কে ২০ হাজারেরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist