নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও শাবি প্রতিনিধি

  ০৬ মার্চ, ২০১৮

জড়িতদের শাস্তি চেয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ মানববন্ধন

সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ : দুই পুলিশ প্রত্যাহার

দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চেয়ে দেশব্যাপী বিক্ষোভ-মানববন্ধন পালন করছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসাধীন জাফর ইকবালকে দেখতে হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আধা ঘণ্টার বেশি সময় সিএমএইচে অবস্থান করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হকের সঙ্গে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসাধীন জাফর ইকবালের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন।

এদিকে, হামলার ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে শাবি বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গতকাল সোমবার সকাল থেকেই দিনব্যাপী ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকতা-কর্মচারীরা। এসব কর্মসূচিতে বিশ^বিদ্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের মূলোৎপাটন করার দাবি জানান তারা।

সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ^বিদ্যালয়ের ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবন থেকে মৌন মিছিল বের করেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) এবং ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে এসে প্রতীকী অবস্থান নেয়। এ সময় উপস্থিত শিক্ষকরা বলেন, হামলাকারী একা নয় তার পেছনে আরো অনেকে জড়িত থাকতে পারে। অবিলম্বে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, জাফর ইকবাল স্যার শুধু শাবির নয়, দেশের সম্পদ। তার ওপর হামলায় আমরা মর্মাহত। আমরা হামলাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

অন্যদিকে প্রশাসনিক ভবন-২ এর সামনে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছে শাবি শিক্ষক সমিতি। কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করেন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ড. জাফর ইকবাল বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ায় আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তার ওপর ন্যক্কারজনক এ হামলা মুক্তচিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত বলে আমার বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাধ্যমে এ দেশ থেকে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করা হবে। আমরা এ ঘটনার মূল হোতাদের বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।

এছাড়াও দিনব্যাপী কালোব্যাজ ধারণ করেছে বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। সন্ধ্যায় মুক্তমঞ্চে রক্তের ঘটনার প্রতিবাদে লালব্যাজ ধারণ ও আলোর মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি কর্মীরা। বিকেলে নাট্য সংগঠন দিক থিয়েটারের সহযোগিতায় ক্যাম্পাসে ‘আততায়ীর খোঁজে, ফাল্গুনের পথে’ স্লোগানে পথনাটক ‘ব্লাড টেস্ট’র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার : ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তায় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বদা তৎপর রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় পুরো ক্যাম্পাস সিসি ক্যামেরা ও পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া দুই সপ্তাহের মধ্যে ক্যাম্পাসের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হবে জানান তিনি।’

অন্যদিকে জঙ্গিবাদসহ শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো ধরনের বিপথে যেতে না পারে সেজন্য প্রতি বিভাগে একজন করে ছাত্র উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। তিনি ছাত্রদের কাউন্সিলিং করবেন। বিভাগগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে কোনো শিক্ষার্থী ১৫ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া হবে।’

দুই পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার : এদিকে জাফর ইকবালের ওপর হামলার সময় দায়িত্বে থাকা দুজন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) আবদুল ওয়াহাব বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, দায়িত্বরত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়টি সমালোচিত হওয়ায় ইবরাহীম ও দীজেন্দ্র নামের দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এদিকে জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে শফিকুর জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার পরপরই হামলাকারী ফয়জুরকে শিক্ষার্থীরা আটক করে তুলে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এ ঘটনায় হামলাকারী ফয়জুর ছাড়া আরো ছয়জনকে আটক করেছে র‌্যাব। রোববার মধ্যরাতে ফয়জুরের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান ও মা মিনারা বেগম জালালাবাদ থানায় আত্মসমর্পণ করলে পুলিশ তাদের আটক করে বলে জানান সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গণামাধ্যম) মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব।

এদিকে হামলার ঘটনায় তিন দিন পেরিয়ে গেলেও অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। এই হামলার পেছনে ফয়জুর একা না আরো কেউ জড়িত তা নিয়ে ধোঁয়াশায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে এ হামলার ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে রয়েছে প্রশাসন। তবে হামলার ঘটনায় তিনজনকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।

জানা যায়, র‌্যাব হেফাজত থেকে ফয়জুরকে গত রোববার রাতে পুলিশের কাছে হস্তানান্তর করা হয়। বর্তমানে সে পুলিশি প্রহরায় সিলেট ওসমানী মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। ফয়জুর সুস্থ হওয়ায় অপেক্ষায় সবাই। তবে এখনো হামলার নেপথ্য কারণ উদ্ঘাটন করতে না পারলেও জঙ্গিদের টার্গেট করেই এগোচ্ছে তদন্ত কার্যক্রম। র‌্যাব-৯ প্রধান লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ বলেন, ফয়জুর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী হয়েই সে এ হামলা চালিয়েছে। তবে ফয়জুর কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়াও বলেছেন, এ হামলা উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কাজ কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে অতীতে এ ধরনের বিভিন্ন হামলার পর বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী অনলাইনে দায় স্বীকার করার খবর প্রকাশ পেলেও জাফর ইকবালের ওপর হামলার দায় এখন পর্যন্ত কোনো সংগঠন স্বীকার করেনি।

গত রোববার সন্ধ্যায় এ ঘটনা তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদিকে হামলার ঘটনায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুলের নাম উল্লেখসহ কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে জালালাবাদ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। অন্যদিকে এ হামলার ঘটনা তদন্তে নেমেছে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট। তাদের একটি টিম রোববার সিলেটে এসেছে বলে জানা গেছে। গত শনিবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফয়জুর রহমানের অতর্কিত হামলায় ছুরিকাহত হন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে এক অনুষ্ঠান চলাকালে এ ঘটনা ঘটে।

সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ : সিলেটে জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। একই সঙ্গে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দেশে যে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গভীর তৎপরতা আশা করেছে সংগঠনটি। গতকাল সোমবার সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, জাফর ইকবালের মতো মেধাবী মানুষটিকে বহু দিন ধরে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে জঙ্গিগোষ্ঠী। কোনো রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে তিনি তার কাজগুলো করে গেছেন। এ রকম মানুষকে হত্যার চেষ্টা করার অর্থ জাতিকে মেধাশূন্য করা। ১৯৭১ সালে ঠিক এ কাজটিই করেছিল পাকিস্তানিরা। সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনামের স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণ শুধু তার ওপরই আক্রমণ নয়, দেশের প্রতিটি মেধাবী মানুষের ওপর আক্রমণ। দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের ওপর আক্রমণ। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় সম্পাদক পরিষদ।

হামলকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি ঢাবি শিক্ষক সমিতির : জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে এক মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানসহ শিক্ষকরা বক্তব্য রাখেন। মানববন্ধন থেকে অধ্যাপক জাফর ইকবাল সুস্থ হওয়ার পর সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযোগে জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। এ কর্মসূচি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সমিতির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দিন তারিখ ঠিক করা হবে বলে জানানো হয়।

জাবিতে প্রতিবাদী গান ও সমাবেশ : অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর বর্বরোচিত হামলার নিন্দায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) প্রতিবাদী গান ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে জাহাঙ্গীরনগর’ স্লোগানে গতকাল বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়।

বিচার চেয়ে চবিসাসের মানববন্ধন : ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে মানববন্ধন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস)। সোমবার দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। চবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আশহাবুর রহমান শোয়েবের সভাপতিত্বে ওই মানববন্ধনে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকসহ সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist