প্রতীক ইজাজ

  ০৬ মার্চ, ২০১৮

জাফর ইকবালের ওপর হামলার নেপথ্যে

নির্বাচনী রাজনীতিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি

দেশবরেণ্য শিক্ষক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে নির্বাচনী রাজনীতিতে। নির্বাচনী বছরে হঠাৎ করেই কেন এমন হামলা-এ নিয়ে নানা মহলে নানা ভাবনার উদ্রেক হয়েছে। এই হামলা কি শুধুই ব্যক্তি জাফর ইকবালকে প্রাণনাশের চেষ্টায় করা; নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে, আলোচনা হচ্ছে তাও। বিশেষ করে নির্বাচন সামনে রেখে এই হামলা একটি অশুভ শক্তির অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অশুভ ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। এমনও মনে করা হচ্ছে, এই হামলার মধ্য দিয়ে চক্রান্তকারীরা আন্তর্জাতিক মহলে দেশের অস্থিতিশীলতার মিথ্যে বার্তা দিতে চায়। তবে এর পেছনে শুধুই কি ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীই দায়ী; নাকি অভ্যন্তরীণ কোনো রাজনৈতিক শক্তি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ওই গোষ্ঠীকে চক্রান্তের অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

হামলার পরপরই হামলার নেপথ্যের কারণ নিয়ে কথা বলেছেন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তাদের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াতে ইসলামীর নাম যেমন এসেছে; তেমনি চিহ্নিত হয়েছে হামলার নেপথ্যের দুটি কারণ। এর মধ্যে একটি হলো অশুভ শক্তির অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা। এই অশুভ ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিকে উসকানি ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য বিএনপি ও জামায়াতের নাম এসেছে। অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী শক্তি দুর্বল হলেও এরা যে নিষ্ক্রিয় হয়নি ও আন্ডারগ্রাউন্ডে সক্রিয় আছে, সে বার্তাও দিয়েছেন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন নেতারা।

তবে এই হামলার নেপথ্যের কারণ ও হামলাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যাপারে খুবই তৎপর সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাফর ইকবালের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ধর্মান্ধরা জাফর ইকবালের ওপর হামলা করেছে। সন্তানদের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত রাখতে এবং এ বিষয়ে তাদের সচেতন করে গড়ে তুলতে অভিভাবক-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। গতকাল প্রধানমন্ত্রী জাফর ইকবালকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) দেখতে যান এবং তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন।

একইভাবে ওবায়দুল কাদের জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। এই হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে। শুধু হামলাকারী ধরা পড়েছে, তা-ই না, এর নেপথ্যে একটি অশুভ শক্তি আছে। তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে যেন কোনো প্রকার গাফিলতির সুযোগ না থাকে-এ বিষয়েও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি এমনও বলেন, কারা হামলা করেছে তা পরিষ্কার। হামলার নেপথ্যে যারা আছে সবাইকে খুঁজে বের করা হবে। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করে লাভ হবে না। এমনকি তদন্তে ‘নেপথ্যের কালপ্রিটরাও’ বেরিয়ে আসবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সরকার কোনো ছাড় দেবে না। হামলাকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও।

গত শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর পর শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়। সেখানে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠান চলাকালে ছুরি হাতে একজন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা করেন। এ সময় ইব্রাহিম নামে পুলিশের এক সদস্যও আহত হয়েছেন। হামলাকারীকে আটক করেন শিক্ষার্থীরা, তার সঙ্গে থাকা আরেকজন পালিয়ে যান।

হামলার পর হামলার নেপথ্য কারণ নিয়ে কথা বলেছেন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা দেশের একটি অশুভ শক্তির অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অশুভ ইঙ্গিত। এমনকি এই হামলাকে সাম্প্রদায়িক শক্তির চক্রান্ত হিসেবে বর্ণনা করে এর সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন এই নেতা। গত রোববার তিনি বলেন, এই হামলা যে একটা চক্রান্ত, এটা সত্য। চক্রান্ত তাদের, যাদের বিএনপি পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। কে ঘটনা ঘটিয়েছে, কারা কারা তাকে দিয়ে ঘটনা ঘটিয়েছে এ বিষয়টা ইতোমধ্যে পরিষ্কার। এ কথা, সে কথা বলে বিভ্রান্তি যারা সৃষ্টি করে, তারা আজকে দেশের স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে না।

একইভাবে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ‘বাংলাদেশে অস্থিরতার’ বার্তা দিতে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়েছে বলে মনে করছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। হামলার পরপরই এক প্রতিক্রিয়ায় এই মন্ত্রী ও সংস্কৃতজন বলেন, গোটা দেশবাসী যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, তখন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতেই এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। উন্নয়নের রাজনীতি বিনষ্ট করার জন্য এ এক অপতৎপরতা। এ হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছিল সেই অপশক্তি যখন এ দেশে বিচরণ করছে। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা। আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা মাঠে নেমেছে। এই অপশক্তির দীর্ঘদিন বিচরণের ফল হচ্ছে জঙ্গিবাদ।

পাশাপাশি এখনো সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী শক্তি যে গোপনে তৎপর, সে কথাও বলেছেন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন নেতারা। নির্বাচনী বছরে এই অপশক্তি আরো তৎপর হতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে এই অপশক্তি তলে তলে আরো অনেক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরা কিছুটা দুর্বল হলেও নিষ্ক্রিয় হয়নি। তারা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে সক্রিয় আছে এবং মাঝে মাঝে হিং¯্র থাবা বিস্তার করছে। এই ঘটনা ঘটিয়ে তারা হয়তো জানিয়ে দিচ্ছে, তারা আরো বড় ধরনের ভয়াবহ হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অনুরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিকভাবে দেশকে অস্থির করে তুলতেই জাফর ইকবালের ওপর হামলা করা হয়েছে। কারণ ২০১৮ সাল অন্য সময়ের মতো নয়। জাতীয় নির্বাচনের বছর। রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময় এখন। রাজনৈতিক উদ্দেশে দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করার একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। জঙ্গিরা মুক্তমনা মানুষকে তাদের বিরোধী শক্তি ভাবে। এই গোষ্ঠী কখনোই চায় না রাষ্ট্রে মুক্তমনা প্রগতিশীল মানুষ থাকুক। তা হলে তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে বাধা পড়ে। বিশেষ করে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ সরকারকে ওরা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ওরা চায় না এই সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসুক।

এই উপাচার্য বলেন, ‘নির্বাচনের বছরে এমনিতেই নানা অপশক্তির নানা ধরনের টার্গেট থাকে। জাতীয় রাজনীতিতে নানা মাত্রা যুক্ত হয়। জাফর ইকবালের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে যেকোনো অপশক্তি সেই মাত্রা যুক্ত করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইতে পারে। তবে ভয় নেই। এখানে মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীল চেতনাবোধ তীব্র। সমাজ ভালো। চাইলেও অশুভ শক্তির উত্থান সম্ভব নয়। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে অনেক ধরনের বড় ঘটনা ঘটে। আমাদের এখানে সেটা নেই। সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে অশুভ শক্তি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে এসব অপতৎপরতা তত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের মতাদর্শের বিরুদ্ধাচরণকারীদের স্তিমিত করতে চায়। তাদের মতাদর্শের পক্ষে সহানভূতি নিতে এই তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারে। নির্বাচনী মাঠে তাদের অনুগত মতাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এই অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।

এই শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমনও বলেন, ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি ভালো করেই জানে জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমান সরকারও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। উভয়পক্ষ তাদের বিরুদ্ধ মতাদর্শের। সুতরাং এই সরকার যেন পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেজন্য এই অন্ধকার শক্তি আবার চাড়া দিচ্ছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে এদের প্রতিহত করা যাবে না। এটি একটি মতাদর্শ যুদ্ধ। সাময়িক দমন করা যাবে হয়তো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তৎপর থাকবে তারা। সুতরাং এদের রুখতে শুভশক্তির সমন্বয়ে সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। সুতরাং আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসুক তা ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা চায় না। তাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী-এ কথা সবাই জানে। সুতরাং এরা প্রশ্রয় পাচ্ছে। জামায়াত-বিএনপি একই লাইনের। এসব জঙ্গির উত্থান এদের থেকেই। এরাই জঙ্গি উৎপাদনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এসব শক্তি এখনো তৎপর। সুতরাং জাফর ইকবালের ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এমন হামলার মধ্য দিয়ে তারা তাদের তৎপরতার জানান দিল। এজন্য নির্বাচনী বছরকেই বেছে নিয়েছে। সুতরাং রাজনৈতিকভাবে আমরা সংঘবদ্ধ হতে না পারলে ধর্মান্ধ অপশক্তিকে রুখতে পারব না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist