বিশেষ প্রতিনিধি
মিছিলে গুলি প্রাণ দিচ্ছে বাঙালি
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কোনো নির্দেশই মানছে না বাঙালি। দমাতে পারছে না সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুও। বিক্ষোভে টালমাটাল পূর্ব পাকিস্তান। অফিস-আদালত বন্ধ। শ্রেণিকক্ষে তালা। কল-কারখানার চাকা ঘুরছে না। রাজপথে শ্রমিক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ। মিছিলে গুলি হচ্ছে। প্রাণ দিচ্ছে বাঙালি। তবু দৃপ্তকণ্ঠে তীব্র স্লোগানÑ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
আজ ৫ মার্চ। উত্তাল মার্চের প্রথম দিন থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছিলেন যে টঙ্গীর শ্রমিকরা, আজ তাদের মিছিলে গুলি চালায় সেনাবাহিনী। প্রাণ দেন চার শ্রমিক। আহত হন ২৫ জন। বিক্ষোভে জ্বলে ওঠে পুরো শিল্প এলাকা। বিক্ষুব্ধ জনতা আগুনে পুড়িয়ে দেয় টঙ্গীর কাঠের ব্রিজ। বড় বড় গাছ ফেলে রাস্তায় রচনা করে ব্যারিকেড। অচল হয়ে পড়ে টঙ্গী। শহীদদের মরদেহ ঢাকায় আসে। শোকে-ক্ষোভে জ্বলে ওঠে ঢাকাও।
চট্টগ্রামে চলা বাঙালি-অবাঙালির মধ্যকার সংঘর্ষে আজ সরাসরি অবাঙালিদের পক্ষ নিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান আরো ১০২ বাঙালি। শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২২ জনে। রাজশাহী ও যশোরে বিক্ষোভরত জনতার ওপর সেনাবাহিনী গুলি ছোড়ে। যশোরে প্রাণ দেন একজন। রাজশাহীতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
দিনটি ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজের পর মসজিদে মসজিদে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় শহীদদের গায়েবানা জানাজা। সেখানকার মসজিদগুলোতে বিশেষ মোনাজাত করা হয় দেশের সংহতির জন্য।
সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। বেতন তোলা ও অতি জরুরি কাজের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয় সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক, অফিস ও রেশন দোকান।
বিকেলে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল। জনতার সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করে রাজপথে নেমে আসেন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শপথ নেন স্বাধীনতার পক্ষের শিক্ষকরা। ডাকসু ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ থেকে বের হয় লাঠি মিছিল।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র গণজমায়েত করে ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ)। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন পরিচালনা করতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু হয়। তোফায়েল আহমেদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের আহ্বান জানান ঢাকা বেতার কেন্দ্রকে।
বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও। একদল স্বাধীনতাকামী বাঙালি কারাগারের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসেন বাইরে। ফটক ভাঙার সময় প্রহরীদের গুলিতে নিহত হন সাতজন। আহত হন ৩০ জন। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসা ৩২৫ বন্দি চলে আসেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শপথ নিয়ে যোগ দেন জনতার আন্দোলনে।
পাকিস্তানের এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আসগর খান বিকেলে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ধানমন্ডির বাসভবনে। রাতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচারে গণহত্যা বন্ধের দাবি জানান।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা আওয়ামী লীগের দাবি অত্যন্ত অবাঞ্ছিত ও আদৌ যুক্তিযুক্ত নয় বলে মন্তব্য করেন।
রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
"