প্রতীক ইজাজ

  ০৫ মার্চ, ২০১৮

বিশিষ্টজনদের অভিমত

ধর্মান্ধ অপশক্তি রুখতে হলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চাই

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে। নানা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন বিশিষ্টজনরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পথে নেমেছে মানুষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাফর ইকবালের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক হামলাকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। গণপিটুনি খেয়ে হামলাকারী ফয়জুর রহমান এখন পুলিশ তত্ত্বাবধানে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুর হামলার কথা স্বীকারও করেছে। সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছে, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি।’ ফলে জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় জঙ্গিবাদ নতুন করে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে দেশের মুক্তমনা মানুষদের। প্রশ্ন উঠেছেÑ তা হলে কি এসব ধর্মান্ধ অপশক্তির নতুন করে উত্থান ঘটছে?

এ নিয়ে গতকাল দেশের তিন বিশিষ্টজনের কথা হয় প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে। এসব বিশিষ্টজনরা এমন পরিস্থিতির জন্য দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে দায়ী করেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হেফাজতসহ বিভিন্ন অপশক্তিকে প্রশ্রয় ও আসকারা দেওয়ার অভিযোগও তুলেছেন। তারা বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া এসব অপশক্তি প্রতিহত করা যাবে না।

গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার পরপর শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়। সেখানে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দুই দিনব্যাপী ‘ইইই ফেস্টিভ্যাল-২০১৮’ এর সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাফর ইকবাল। অনুষ্ঠান চলাকালে ছুরি হাতে একজন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা করেন। এ সময় ইব্রাহিম নামে পুলিশের এক সদস্যও আহত হয়েছেন। হামলাকারীকে আটক করেন শিক্ষার্থীরা, তার সঙ্গে থাকা আরেকজন পালিয়ে যায়।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও জঙ্গিদের হাতে নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, জাফর ইকবালের ওপর জঙ্গিদের হামলার ঘটনা কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। প্রতি মাসেই দেশের বিভিন্ন স্থানে কোনো না কোনো বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা মিলছে। জঙ্গিদের আটক করছে র‌্যাব-পুলিশ। জঙ্গিবাদের প্রমাণাদি মিলেছে। ওরা শেষ হয়ে যায়নি। বরং গোপনে গোপনে এখনো সংঘবদ্ধ। তারই শেষ উদাহরণ জাফর ইকবালের ওপর হামলা। জঙ্গি তৎপরতা ক্রমাগত বাড়ছে। বন্ধ হয়নি।

এই শিক্ষাবিদের মতে, দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর অপতৎপরতা ও এসব অশুভ শক্তিকে রুখতে হলে এর বিরুদ্ধে শুভশক্তির সংঘবদ্ধতা দরকার। যারা গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে এবং চর্চা করে, অর্থাৎ এসব রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে শুভশক্তি দরকার। দেশে রাজনীতির যে অবস্থা, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে মনোবল কমে গেছে। নানা অনাচার হচ্ছে। আংশিকভাবে নয়, সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক সংজ্ঞার পরিবর্তন আনতে হবে। গণতন্ত্র হতে হবে জনগণের স্বার্থে। সেই গণতন্ত্র যদি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ায়, তবেই এসব অপশক্তি রোধ করা যাবে। তখন মানুষও সমর্থনে পথে নামবে।

এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। মন্ত্রিত্বেও পরিবর্তন আসছে। কিন্তু রাজনীতি ও গণতন্ত্রের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সঠিক পথে কিছুই হচ্ছে না। দেশকে অশুভ শক্তিমুক্ত করতে হলে রাজনৈতিক পরিবর্তনটা জরুরি। এমন রাজনীতি হতে হবে, তাতে যেন সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা থাকে। তবেই সম্মিলিত শক্তি জঙ্গিবাদ বা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। নতুবা এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান অবশ্য জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনাকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, একটি কারণ হতে পারে রাজনৈতিকভাবে দেশকে অস্থির করে তোলা। কারণ ২০১৮ সাল অন্য সময়ের মতো নয়। জাতীয় নির্বাচনের বছর। রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময় এখন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করার একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অন্যদিকে, জঙ্গিদের মুক্তমনা মানুষের প্রতি শ্যোনদৃষ্টি থাকতে পারে। এই গোষ্ঠী কখনোই চায় না রাষ্ট্রে মুক্তমনা প্রগতিশীল মানুষ থাকুক। তা হলে তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে বাধা পড়ে।

এই উপাচার্য বলেন, নির্বাচনের বছরে এমনিতেই নানা অপশক্তির নানা ধরনের টার্গেট থাকে। জাতীয় রাজনীতিতে নানা মাত্রা যুক্ত হয়। জাফর ইকবালের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে যে কোনো অপশক্তি সেই মাত্রা যুক্ত করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইতে পারে।

‘তবে ভয় নেই। এখানে মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীল চেতনাবোধ তীব্র। সমাজ ভালো। চাইলেও অশুভ শক্তির উত্থান সম্ভব নয়। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে অনেক ধরনের বড় ঘটনা ঘটে। আমাদের এখানে সেটা নেই। সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে’Ñ যোগ করেন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।

তিনি এমনও বলেন, অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ ধরনের হামলা আগেও হয়েছে; যা কোনো সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর কাজ বলে মনে হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক অবিলম্বে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের হামলা আর না হয় সে ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও অনুরোধ করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী হত্যার হুমকি সবসময়ই দিয়ে আসছে। খুদেবার্তা পাঠাচ্ছে। এই অপশক্তি আসকারাটা পেয়েছে হেফাজতের তা-বের সময় থেকে। সরকার এদের আসকারা দিয়েছে। হেফাজতকে প্রশ্রয় দেওয়া না হলে এরা এমন হামলা বা হুমকির সাহস পেত না। হেফাজত যাকে ইচ্ছা গালিগালাজ করল। ইন্টারনেটে নানা তথ্য প্রচার করল আমাদের বিরুদ্ধে। অথচ আমরা এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলাম না। এদের এসব অপপ্রচার হুমকি-ধমকি বন্ধ করতে পারলাম না। ওদের কাছে মুক্তমনা মানুষের তালিকা আছে। ওরা সেই তালিকা ধরে ধরে হত্যা করছে। হত্যা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা কী করব?

এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, জামায়াত-বিএনপি একই লাইনের। এসব জঙ্গিদের উত্থান এদের থেকেই। এরাই জঙ্গি উৎপাদনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এসব শক্তি এখনো তৎপর। সুতরাং জাফর ইকবালের ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।

‘আমাদের রাজনীতি ও সরকারগুলোরও একটা সমস্যা আছে। সুশীল সমাজের সব কথা হয়তো ঠিক না। কিংবা বিতর্ক আছে। কিন্তু যে কথাগুলোর মধ্যে যুক্তি আছে, কাজের, সেগুলোও সরকার নাকচ করে দেয়। মানে না। আমরা বারবার হেফাজতসহ অপশক্তিগুলোকে প্রশ্রয় না দেওয়ার জন্য বলছি। কিন্তু তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের প্রতিপক্ষ ভাবে। ক্ষমতায় গেলে শত্রু মনে করে। সুতরাং রাজনৈতিকভাবে আমরা সংঘবদ্ধ হতে না পারলে ধর্মান্ধ অপশক্তিকে রুখতে পারব না’Ñ বলে মত দেন মুনতাসীর মামুন।

এই শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মুক্তমনা মানুষদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, জাফর ইকবালের পেছনে যে পুলিশ ছিল, তার পাশেই কিন্তু হামলাকারী দাঁড়িয়ে ছিল। ওই পুলিশের মধ্যে দুজন মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সুতরাং নিরাপত্তাটা দিল কই? যাদের নিয়ে আশঙ্কা, বারবার হুমকি পাচ্ছে, সেই আমরাও কিন্তু নিরাপত্তা পাচ্ছি না। আমাকে ও শাহরিয়ারকে (লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীর) এখনো নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি। দিচ্ছি দিচ্ছি বলে সময় যাচ্ছে। সরকারের বোঝা উচিত এসব অপশক্তিকে কোনোভাবেই কোনো কারণেই প্রশ্রয় বা আসকারা দেওয়া যাবে না। ওরা সবসময়ই প্রগতিশীল মানুষের বিরুদ্ধে। ওরা সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist