কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম ছাত্রলীগে কেন এই কোন্দল হানাহানি!
চট্টগ্রামে কোনোভাবেই ছাত্রলীগ কর্মীদের সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তারা পেশিশক্তি একের পর এক প্রদর্শন করে চলছেন। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে তারা এখন হিং¯্র মূর্তিতে আবিভর্‚ত। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ছাত্রলীগ কর্মীর অনেকেই। এর পেছনে রয়েছে পর্দার আড়ালের রাজনীতি। যা ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে কোন্দল ও হানাহানি বাড়াচ্ছে।
গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর জেলা ছাত্রলীগ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ তিনটির অধিক ঘটনায় জড়িয়েছে। গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে ককটেল বিস্ফোরণ, হাতহাতির ঘটনা ছাত্রলীগের এই যথেচ্ছাচারের আরো এক নজির।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন বানচালের উদ্দেশে হাটহাজারী উপজেলার সাধারণ সম্পাদক পদে প্রত্যাশী ছাত্রলীগের নেতারা এই গন্ডগোল সৃষ্টি করেন। যদিও মীরসরাই থেকে সভাপতি পদে প্রত্যাশী প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্য উপজেলার
নেতাদের কারো আপত্তি ছিল না। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য হাটহাজারী থেকে প্রার্থী ছিলেন ১৪ জন। তবে সম্মেলনের আগের দিন নেতাকর্মীদের কাছে খবর রটে যায় যে, সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য স›দ্বীপের প্রার্থী মফিজুল ইসলাম জিকুকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এ পদের জন্য রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুন্ড ও ফটিকছড়ির বাসিন্দা এই পদের প্রত্যাশীরা। তাই তারা পরিকল্পিতভাবে সম্মেলনে গন্ডগোল সৃষ্টি করে পন্ড করে দেন।
অতীতের মতোই দুষ্কৃতকারীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এ বিষয়ে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তৈয়ব ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সম্মেলনে ঢুকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার সময় আগুন সন্ত্রাসীরা বহিরাগত হিসেবে এসে হামলা করেছে। একই বক্তব্য দিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশৃঙ্খলা করে না। তারা শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। বহিরাগতরাই ঢুকে এ হামলা চালিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করা হবে। সন্ত্রাসী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী যে-ই হোক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ঘটনার পরপর জ্যেষ্ঠ নেতারা ঘোষণা দেন। কিন্তু এখানে ককটেল বিস্ফোরণ, ভাঙচুর, মারধর করা হলেও অপরাধদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা তো দূরের কথা, কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। পুলিশের সামনেই এ ঘটনা ঘটেছে এবং পুলিশ সরকার-সমর্থক এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখায়নি। এ ঘটনায় পাঁচজন আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ভর্তি হলেও হয়নি মামলা।
অভিযোগ উঠেছে নেতাদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো নেতার সমর্থকদের ইন্ধন রয়েছে। এখানে প্রায় প্রত্যেক নেতার সমর্থনে আলাদা আলাদা কর্মী বাহিনী রয়েছে। সম্মেলন বা যেকোনো অনুষ্ঠানে কোনো নেতার আধিপত্য খাটো হলে বা কোনো নেতার সমর্থকরা কাক্সিক্ষত পদ-পদবি না পেলে অনুষ্ঠান পন্ড করার খেলায় তারা মেতে উঠে। পরিকল্পিত এসব গন্ডগোলের বিষয়টি আগে থেকে বড় বড় নেতারাও জানেন। কিন্ত কেউ কাউকে দোষারোপ করেন না। বিগত দুটি অনুষ্ঠান পন্ডের পেছনে এসব কারণই দায়ী বলে মনে করছেন সাধারণ কর্মীরা। এর ফলে প্রভাব পড়ছে দলে।
এর আগে গত ২০ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালায় ছাত্রলীগের একটি অংশ। হামলাকারীরা প্রক্টর কার্যালয় ছাড়াও বাইরে থাকা প্রক্টর, সময় টেলিভিশন ও অন্য একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এছাড়া পরিবহন দফতরে ৯টি বাস, ৩টি মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুর করা হয়।
হামলাকারীরা ক্যাম্পাসে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ১৯ ফেব্রæয়ারি দুপুরে ক্যাম্পাসে প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছিরের আনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর রাতে দুইটি হলে তল্লাশি চালিয়ে দেশীয় ধারালো ও দুইটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। তল্লাশির সময় ‘পুলিশের দুর্ব্যবহারের’ প্রতিবাদে ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে নাছিরের অনুসারী চবি ছাত্রলীগের অংশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক বন্ধ করে দিয়ে এই তান্ডব চালায়।
পরে এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ঘটনায় চার শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে বলে গত ২৬ ফেব্রæয়ারি তথ্য দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কৃতরা সবাই চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধরণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী।
এ বিষয়ে প্রক্টর আলী আজগর চৌধুরী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসিডেন্ট, হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৬ ফেব্রæয়ারি কয়েক পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী স্মরণে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ আয়োজিত সভা। সেদিন বিকাল ৪টার দিকে সভা শুরুর পর থেকেই হাততালি, ব্যানার উঁচিয়ে রাখা আর চেয়ার ছুড়ে সামনের দিকে এসে ভিড় করে পাল্টাপাল্টি ¯েøাগানের মধ্যেই সভার কার্যক্রম চলতে থাকে। মূলত নগরীর ওমর গণি এমইএস কলেজকেন্দ্রিক কয়েকজন নেতার অনুসারীদের মধ্যেই ?দুই দফায় সংঘর্ষ হয়।
ওমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস আরশেদুল আলম বাচ্চুর বক্তব্যের শেষ দিকে নগর ছাত্রলীগের উপসম্পাদক মিনহাজুল আবেদিন সানির অনুসারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুর রহমান শামীমের অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। এ সময় ছোটাছুটি শুরু হলে পুরো সভাস্থল ধুলোর রাজ্যে পরিণত হয়। বাঁশের ঘেরা ডিঙিয়ে বেশকিছু নেতাকর্মী মঞ্চের সামনে চলে আসেন। এ সময় একপক্ষ আরেকপক্ষের ওপর চেয়ার ছুড়তে থাকে। মাঠজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মঞ্চে থাকা ছাত্র ও যুবলীগ নেতারা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যান। তারা একযোগে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ¯েøাগান দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান।
এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে কয়েকজন নেতা বক্তব্য রাখেন। সাড়ে ৫টায় আবারও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মিনহাজুল আবেদিন সানি এবং এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ওয়াসিমের অনুসারীরা। এ সময় চেয়ার ছোড়াছুড়ি, কিল-ঘুষি, লাঠির আঘাত, দৌড়াদৌড়িতে পুরো সভা স্থলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে এক রকম তড়িঘড়ি করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহিউদ্দিনপুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও প্রধান অতিথি ড. অনুপম সেন বক্তব্য দিয়ে সভা শেষ করেন।
"