গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নির্বাচনী অপরাধের শাস্তি

অবাধ ক্ষমতা পাচ্ছেন বিচারিক কর্মকর্তারা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থী অপরাধে জড়ালে সুপারিশ ছাড়াই এখন সরাসরি শাস্তি দিতে পারবে ‘নির্বাচন তদন্ত কমিটি।’ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে, ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধনী এনে এই অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে কমিটিকে; যার দায়িত্ব পালন করেন বিচারিক কর্মকর্তারা। এর আগে এ কমিটি শুধুমাত্র ‘অপরাধের শাস্তি’র জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করত।

এদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র কোনো ব্যক্তি প্রার্থী হলে মোট ভোটারের এক শতাংশের স্বাক্ষর নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হতো; এ ঘটনায় অনেক ব্যক্তি প্রার্থী হওয়া থেকে বঞ্চিত হতেন। এখন শর্ত শিথিল করায় এসব প্রার্থী এক হাজার ভোটারের স্বাক্ষর জমা দিয়ে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাবেন। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীর সব ধরনের ডিজিটাল প্রচারণা বন্ধ হচ্ছে। তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের পরবর্তী পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ বহাল থাকবে। ফেসবুক, টুইটার, ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড ব্যবহার নিষিদ্ধ। বন্ধ হচ্ছে মনোনয়নপত্র দাখিল ও নির্বাচন-পূর্ব সময়ে মিছিল কিংবা শোডাউন। প্রচারণায় ব্যবহার করা যাবে না জীবন্ত প্রাণীর ছবি। তাছাড়া উপজেলা ভেঙে সংসদীয় আসনের বিন্যাস করা যাবে, যা এ-সংক্রান্ত আইনে অন্তর্ভুক্ত করে খসড়া চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে।

নির্বাচনের আইন সংস্কার কমিটি গতকাল মঙ্গলবার সভা করে আরপিও সংশোধনী আইন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিধিমালা, সংসদ নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা এবং সীমানা বিন্যাস আইনের খসড়া চ‚ড়ান্ত সাপেক্ষে কমিশনে প্রস্তাব উপস্থাপনের সুপারিশ জানিয়েছে। এতে আরপিও ও সীমানা বিন্যাস আইন সংশোধনী সাপেক্ষে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা কার্যকর হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরপিওতে ৩০টির বেশি সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে বলে ইসির কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

জানা যায়, আরপিওর ৯১ এ(১) ধারায় সংশোধনী এনে বিচারিক কর্মকর্তাদের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনে অপরাধের জন্য তাদের সামারি ট্রায়ালের ক্ষমতা ছিল না। এমনকি অপরাধের শাস্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনকে সুপারিশ জানাতেন। বিদ্যমান সংশোধনী আইনে ইলেকট্ররাল ইনকোয়ারি কমিটিকে অপরাধের সাজা প্রদানে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থী অপরাধ করলে সামারি ট্রায়াল করে তাৎক্ষণিক সাজা দিতে পারবেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। প্যানেল কোডে যেভাবে অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে তার আলোকে সাজা দেবেন তারা। নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটে ভোটদান প্রক্রিয়া সহজ করা হচ্ছে। ইভিএম-ডিভিএম আইনে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। জমা দেওয়া যাবে অনলাইনে মনোনয়নপত্র। নির্বাচনে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের শাস্তি বাড়ছে। আরপিওর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় যুক্ত হচ্ছে না সেনাবাহিনী। কমিটির ভাষায়, প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশরক্ষা বাহিনী। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে তারা নির্বাচনের কাজে যুক্ত হবে।

কমিটির অন্য সুপারিশের মধ্যে নির্বাচনে অবৈধ টাকার প্রভাব ও প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়সীমা নির্দিষ্ট রাখতে ব্যয় মনিটরিং কমিটি ও অডিটের নিমিত্তে আলাদা কমিটি গঠন, নির্বাচনে অভিযোগ দাখিল ও তা দ্রæত সময়ে নিষ্পত্তি হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফেরাতে এ বিধান সংযোজন, নির্বাচনে কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বদলি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাজা বাড়িয়ে সর্বনি¤œ তিন বছর করার বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, নির্বাচনী অভিযোগ দ্রæত নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীকে জানিয়ে দেওয়া, প্রার্থীদের জামানত ফি বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা এবং তা অফেরতযোগ্য বিধান যুক্ত করা, প্রার্থীদের হলফনামায় মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সার্টিফিকেটের পাশাপাশি মার্কশিট সংযোজনের বিধান সংযোজন, সংসদ নির্বাচনে বড় জেলায় দুজন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের ফলে জটিলতা তৈরি হয়। তাই এটা নিরসনে জেলার পাশাপাশি আসন শব্দটি যোগ করা এবং নির্বাচনে বড় ধরনের অনিয়ম রোধে নিজস্ব কর্মকর্তাদের স্থায়ী দায়িত্ব পালনের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ থাকছে আইন সংস্কার কমিটির সুপারিশে।

একইভাবে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য একটি আসনের মোট ভোটারের ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা ওই প্রার্থীর জন্য ছিল মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা। বড় বড় রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি নামসর্বস্ব সব দলই ওই বিধানের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু কমিশন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ১ শতাংশের বিধান তুলে দিয়ে ভোটার নির্দিষ্ট করার সুপারিশ করছে। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ভোটার সংখ্যা ১ হাজার নির্দিষ্ট করা হচ্ছে।

সংসদীয় আসনের সীমানা বিন্যাস কার্যক্রম আগামীতে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে জেলাওয়ারি আসনের আয়তন, জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যা, উপজেলার অখÐতা রক্ষা করে বিন্যাস করার সিদ্ধান্ত ছিল আইন সংস্কার কমিটির। তারা আরো জানায়, উপজেলা অখÐতার ওপর গুরুত্বারোপ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন সংশোধনের সুপারিশ চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে উপজেলা ভেঙেও সীমানা নির্ধারণ করা যাবে। জেলার আসনসংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ কমবেশি করার বিধান রাখা হয়েছে।

নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনার ও জেলার ভেতরে ডিসি সভা করার অনুমতি দেন। সভা করার লিখিত আবেদনপ্রাপ্তির সময়ের ক্রমানুসারে অনুমোদন দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ বিধানের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। আচরণবিধিতে ডিজিটাল প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দুটি বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বিধিমালার ৭(৮) ধারা যুক্ত করে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রকার ইলেকট্রনিক মাধ্যম বা ডিসপ্লে বোর্ড ব্যবহার করা যাবে না। ৭(ক) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, ফেসবুক, টুইটার, ভাইভারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো প্রার্থী বা সমর্থক অথবা রাজনৈতিক দল কোনো প্রকার প্রচারণা চালাতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ বিধান ভঙ্গ করলে প্রার্থী বা সমর্থক করাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। আর রাজনৈতিক দল এধারা লঙ্ঘন করলে অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে।

আচরণ বিধিমালায় ভোটকেন্দ্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতে রাখার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আচরণ বিধিমালার ৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী বা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নির্বাচন-পূর্ব সময় ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো সভায় অংশ নেবেন না এবং কোনো কাজে জড়িত হবেন না। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার কোনো বিধান ভঙ্গ করলে তা ইলকটোরাল এনফোর্সমেন্ট অফিসার সংক্ষিপ্ত শুনানি করে বিধি ১৮(১) এ উল্লেখিত শাস্তি দিতে পারবেন।

উল্লেখ্য, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসি ঘোষিত রোডম্যাপের সাতটি কর্মপরিকল্পনার প্রথমটি হলো আইন ও বিধিমালা সংস্কার। এতে গত ডিসেম্বরের মধ্যে আইন সংস্কারের প্রাসঙ্গিক খসড়া তৈরি এবং ফেব্রæয়ারির মধ্যে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ওই রোডম্যাপ থেকে পিছিয়ে থাকলেও ফেব্রæয়ারির মধ্যে খসড়া চূড়ান্ত করল এ কমিটি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist