প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ফিরে যেতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায় রোহিঙ্গারা

নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকটের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি যে ধরনের সহমর্মিতা গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে স্থানীয়দের মধ্যে সেই মনোভাবের পরির্বতন দেখা গেছে। অপরদিকে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলে ফিরে যাবেন বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা। এদিকে, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকার নির্ধারিত ৩ হাজার একর জমি ছাড়াও ক্যাম্পের আয়তন বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা বসতিগুলো সরিয়ে সেখানে পুনঃস্থাপন করা হবে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ২ লাখ রোহিঙ্গা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের ক্ষতি এড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গতকাল রোববার কক্সবাজার শহরের কলাতলীর একটি হোটেলে ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ আইএসসিজির উদ্যোগে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী রেসপন্সের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। গত বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে এসেছে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা।

এর আগে কয়েক দফায় আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে মোট ১০ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। এদিকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে এ পর্যন্ত কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে দুই দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। এসব বৈঠকে প্রাথমিকভাবে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার সরকার। একই সঙ্গে জিরো লাইনে আটকে পড়া আরো সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষকে তারা ফিরিয়ে নেবে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছে।

কিন্তু নতুন করে আসা সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া কতটা সহজ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কথা হয় সাবিনা নামে রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে। গত বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে যখন তার স্বামীকে হত্যা করে তখন দুই সন্তান নিয়ে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু প্রায় ছয় মাস কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজ দেশের মংডুতে ফিরে যাবেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের সেখানে জমি-জমা আছে। যদি ঘরবাড়ি এখনো অবশিষ্ট থাকে আর আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হয় তাহলে আমি অবশ্যই ফিরে যেতে চাই।’ সাবিনার মতো আরো অনেকেই বলছেন, তারা তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে চান।

তিনি বলছিলেন ‘রিফিউজি হওয়া তো আমাদের উদ্দেশ্য না। মিয়ানমার যদি নিরাপদ হয় তাহলে আমরা চলে যাব। আমাদের সেখানে জমি-জমা বুঝিয়ে দিতে হবে, ঘরবাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। শুনেছিলাম আনান কমিশনের একটি রিপোর্ট দিয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন হলে আমাদের সেখানে অসুবিধা হবে না বলে মনে করি।’

প্রত্যাবাসন নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক আর চুক্তি হলেও মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা ভিন্ন। এ সম্পর্কে কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘এত অধৈর্য হলে চলবে না। একটি আলোচনা শুরু হয়েছে, অগ্রসর হয়েছে এবং আমরা মাঝ পথে আছি। হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’ কিন্তু তালিকায় থাকা সবাই কি জানে যে তাদের ফেরত পাঠানো হবে? আবুল কালাম বলেন, ‘৮ হাজার ৩২ জনের যে তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠানো হয়েছে সে সম্পর্কে তালিকায় থাকা মানুষরা কিছুই জানেন না।’

মিয়ানমার রোহিঙ্গা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান রকিবুল্লাহ বলছেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের কাছে খুব কম তথ্য আছে। অনেকেই এ সম্পর্কে জানেন না।

রকিবুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে থাকতে চাই না কিন্তু সঠিকভাবে আমাদের সব অধিকার নিশ্চিত করে তারপর ফেরত পাঠাতে হবে।’

অপরদিকে, এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্তে বেড়া নির্মাণের জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলারের অনুমোদন দিয়েছে দেশটির সংসদ। দেশটির সংসদ সদস্য মিও জ অংয়ের বরাত দিয়ে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এই খবর জানিয়েছে। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রণালয় সীমান্তে বেড়া দেওয়ার বাজেটটি পেশ করে। দেশটিতে এসব মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে।

ডেপুটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল অং সু জানিয়েছেন, সীমান্তে ২৯৩ কিলোমিটার বেড়া নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে ২০২ কিলোমিটার বেড়া নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি। গত অক্টোবরে মিয়ানমারে বৌদ্ধরা সেনাবাহিনীকে নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।

এদিকে, এখনো রোহিঙ্গাদের আসা কমবেশি অব্যাহত রয়েছে, কবে নাগাদ তাদের ফেরত নেওয়া হবে? এসব প্রশ্নে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ছে? এসব নিয়ে বিবিসির এক সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া উপজেলায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার কারণে স্থানীয়দের জীবনে যে একটা সার্বিক পরিবর্তন এসেছে। মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন একজন কৃষক বলছিলেন, ‘তাদের থাকার জায়গা করতে গিয়ে চাষের কোনো জমি নেই এখন। গাছপালা কেটে একাকার করে ফেলেছে। আমাদের এখন কোনো কাজ নেই।’ মো. শাহাবুদ্দিন বলছিলেন, দিনমজুরের কাজ এখন আর স্থানীয়রা পাচ্ছেন না। কারণ রোহিঙ্গারা এসে অল্প টাকায় সব কাজ করছে।

প্রথম যখন রোহিঙ্গা আসছিল তখন কারো ধারণা ছিল না কী সংখ্যায় তারা আসবে এবং কত দিনের জন্য তারা বাংলাদেশে থাকবে।

ওই প্রতিবেদক বলেন, ‘আমি গত ছয় মাসে দুইবার এই এলাকায় এসেছি প্রতিবেদন তৈরির জন্য, তখন আমি দেখেছি মানুষের মধ্যে একটা মানবিকতা বোধের কারণেই অনেকেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে, তাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু ছয় মাস পরে পরিস্থিতি এবারে ভিন্ন।’

স্থানীয় একজন বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলছিলেন, ‘বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমাদের স্থানীয়দের ওপর বিরাট চাপ পড়ছে।’ তিনি বলছিলেন, ‘ধরেন এখানে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আর ৬০ হাজার এনজিও কর্মী আছে। রাস্তায় বের হলে কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না, আগে যেখানকার ভাড়া ছিল ২০ টাকা, এখন সেখানে ৪০ টাকা ভাড়া।’

তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলÑ ‘যখন রোহিঙ্গারা এসেছিল তখন বলেছিলেন মানবিকতার কারণে তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন, তাহলে এখন এমন কথা কেন?’ এমন কথার উত্তরে তিনি বললেন, ‘কয়েক মাসের জন্য আশ্রয় দেওয়া যায় কিন্তু মাসের পর মাস তো সম্ভব না।’

‘প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বার বার বিলম্বিত হচ্ছে এটাও ঠিক না। আমরা চাই তাদের মিয়ানমারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত যাতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।’

কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ, বালুখালি, কুতুপালংয়ের নানা পেশা, শ্রেণীর মানুষের অভিমত এমনই। সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা এবং কয়েক হাজার উন্নয়ন কর্মীর চাপে এই এলাকাতে স্থানীয়দের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে।

মুদি দোকানদার মো. রফিক বলছিলেন, সব জিনিসের দাম বেড়েছে। তিনি বলছিলেন, ‘আগে ময়দার দাম ছিল ২৫ টাকা এখন সেটা ৩৫ টাকা হয়েছে। ৩০ টাকা দিয়ে লাকড়ি (জ্বালানি কাঠ) কিনতাম এখন সেটা ২০০ টাকা হয়েছে। চালের দাম ৪৫ টাকা। শাকসবজির দাম অনেক। চারদিক দিয়ে সমস্যায় আছি আমরা।’

ঘুমধুম হাইস্কুলের একজন শিক্ষক আবদুল গফুর নতুন এক তথ্য দিলেন। তিনি বলছিলেন, স্কুলের নবম এবং দশম শ্রেণীর অনেক শিক্ষার্থী এখন পার্টটাইম কাজ করছে বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে। ফলে তাদের পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলছিলেন, ‘এখন যা চলছে তাতে করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। মেধাশূন্য হয়ে পড়বে সব এক সময়।’ কক্সবাজারের মানুষের মনে আগের সেই সহমর্মিতা ছাপিয়ে এখন চাপা অসন্তোষ, কখনো সেটা প্রকাশ পাচ্ছে প্রকটভাবেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist