শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

চট্টগ্রামে ছিনতাই : তথ্য প্রমাণ পেয়েও নীরব পুলিশ

‘ছিনতাইকারীদের ছবি, তাদের ব্যবহার করা সিএনজি অটোরিকশার নাম্বার আছে। ঘটনার ভিডিও ফুটেজও আছে। পুলিশ যা জানতে চেয়েছে সবই দিয়েছি। এরপরও তারা কাজ করেনি। না করলে তো জোর করে করানো যাবে না। আমি নিরীহ লোক, অসহায়। কী আর বলব!’

পুলিশের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে হতাশ হয়ে ফেরা চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানাধীন ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার ব্যবসায়ী আনসার উদ্দিন কথাগুলো বললেন। গত ৭ ডিসেম্বর ফিরিঙ্গিবাজারের অদূরে অনিক ইলেক্টনিক্সের পাশে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলেন তিনি। ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় আনসারকে ছুরি মেরেছিল ছিনতাইকারীরা। সেদিনের ঘটনার ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিকেল ৩টা ৪১ মিনিটে রিকশা নিয়ে ব্যাংক থেকে ফিরছিলেন ব্যবসায়ী আনসার উদ্দিন। রিকশাটিকে পেছন থেকে অনুসরণ করছিল একটি সিএনজি অটোরিকশা। রিকশার কাছে এসে হঠাৎ থেমে যায় সিএনজি অটোরিকশাটি। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে দৌড়ে রিকশাকে আটকাতে যায় একজন। রিকশাচালক চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর আরো দুজন ওই সিএনজি অটোরিকশা থেকে দৌড়ে নেমে রিকশায় থাকা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেন। এ সময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীকে ছুরি মারেন ছিনতাইকারীরা। এরপর প্রাণে বাঁচতে যেদিক থেকে যাচ্ছিলেন সেদিকে দৌড় দেন আনসার উদ্দিন। সড়কের অপরদিকে সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে পালায় ছিনতাইকারীরা। পুরো ঘটনাটি ঘটেছে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে।

ব্যবসায়ী আনসার উদ্দিন বলেন, ‘জনতা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফেরার সময় ছিনতাইয়ের শিকার হই। ৫০ হাজার টাকা ছিল, তা নিয়ে গেছে।’

ঘটনার পরপর কোতোয়ালি থানায় মামলা করতে যান আনসার উদ্দিন। তখন ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে থাকা একজন নারী কর্মকর্তাকে ঘটনা খুলে বলেন তিনি। তখন পুলিশ কর্মকর্তা জানালেন, পুলিশের টিম ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর মামলা নেয়া হবে। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্যতা পেলেও মামলা নেয়নি বলে দাবি করেন ভুক্তভোগী আনসার উদ্দিন; তিনি বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনার পর আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছি আমি। ফুটেজ দেখে সিএনজি অটোরিকশাটির নাম্বারও (চট্ট মেট্রো-থ :১১-৯৫২১) বের করেছি। এসব পুলিশকে দিয়েছি। এরপরও ছিনতাইয়ের ঘটনায় তারা মামলা না নিয়ে জিডি নিয়েছে। থানায় তিনবার গিয়ে ওসিকে পাইনি। একবার ওসি থানায় থাকা অবস্থায় গিয়েছিলাম, তখন তিনি রেস্টে আছেন জানিয়ে কনস্টেবল দেখা করতে দেননি।’

আনসার উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘এসআই মাহবুব ও পরে পাথরঘাট ফাঁড়ির এসআই শহীদুর রহমান জিডিটি তদন্ত করেন। পুলিশ টাকা চাইলে আমি বলেছিলাম, ভাই টাকা দেয়া তো সম্ভব না, টাকা উদ্ধার হলে তখন দেয়া যাবে। এখন বুঝতে পেরেছি আমি, টাকা না দেওয়ায় ছিনতাইকারীদের ধরেনি পুলিশ।’

নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে আনসার বলেন, ‘টাকা যাওয়ার পরও আমি যে হয়রানির মুখে পড়েছিÑ তা বলার মতো নয়। আমি ডায়াবেটিসের রোগী। ছিনতাইকারীরা হাতে ছুরি মেরেছিল, চিকিৎসায় ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। অনেক দিন ব্যবসায়িক কাজ করতে পারিনি। অনেক কষ্ট পেয়েছি ভাই। পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ঘটনার ফুটেজ নিয়ে গিয়েছি। আমি একলা মানুষ। ব্যবসা করব, পেটের জোগান দেব। নাকি থানায় দৌড়াদৌড়ি করব?’

জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ওসি জসীম উদ্দীন বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনা হলে অবশ্যই মামলা হবে। আপনি এখনই তাকে (ভুক্তভোগী) থানায় আসতে বলুন।’ ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে অনেক সময় ওসির সাক্ষাৎ পান নাÑ এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে জসীম উদ্দীন বলেন, ‘আমি সবসময় থানায় থাকি।’

এদিকে শুধু এই একটি ঘটনায় নয়; নগরের হালিশহর থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার মহরম সুলতানা সিক্তা নামের এক নারীও ছিনতাইকারীর পরিচয় নিয়ে ঘুরছেন পুলিশের দুয়ারে দুয়ারে। গত ২৮ জানুয়ারি দুপুরের ওই ঘটনায় ছিনতাই হওয়া হাতব্যাগে একটি আইফোন (সিক্স প্লাস) ও একটি স্যামসাং মোবাইলসহ বেশকিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল। এ কাজে সিএনজি চালকসহ পাঁচ ছিনতাইকারী পৃথকভাবে ব্যবহার করে একটি মোটরসাইকেল ও একটি সিএনজি অটোরিকশা। যে দৃশ্য স্থানীয় বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।

সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, ২৮ জানুয়ারি দুপুর ২টা ২৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে সিসিটিভি ফুটেজের আওতায় আসেন ছিনতাইয়ের শিকার মহররম সুলতানা সিক্তা। তার পিছু নিয়ে ২টা ২৯ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে আসে ছিনতাইকারীদের মোটরসাইকেলটি। ১০ সেকেন্ড না যেতেই দৃশ্যপটে হাজির ছিনতাইয়ে সহায়তাকারীদের একটি সিএনজি অটোরিকশা। পরবর্তী ৩০ সেকেন্ডে ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি। এদিকে দিনে দুপুরে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েও দমে যাননি মহররম সুলতানা সিক্তা। নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করেছেন ছিনতাইয়ের সময়ের বেশকিছু সিসিটিভি ফুটেজ, এমনকি নিজেই সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনাসহ নানাভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে ছিনতাইকারীর ছবি ও ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত সিএনজি অটোরিকশার নম্বর (চট্ট মেট্রো-থ : ১২-৩৮১০) শনাক্ত করেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ওই ঘটনায় নড়াচড়া নেই পুলিশের।

ভুক্তভোগী মহররম সুলতানা সিক্তা বলেন, ‘ঘটনার দিনই আমি হালিশহর থানা পুলিশকে জানালে মামলা না নিয়ে অভিযোগ করতে বলে। পরে নানাভাবে চেষ্টা করে ছিনতাইকারীর ছবি ও ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর শনাক্ত করে পুলিশকে দিয়েছি। কিন্তু তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। ’

এ বিষয়ে হালিশহর থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি ছিনতাই নয় ‘চুরি’। ছিনতাই আর চুরির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। আপনি ভিকটিমকে পাঠান, মামলা নেব।’

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) মো. ফারুক উল হক বলেন, ‘এ ঘটনায় দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন ওসি। আসলে কি বলব, জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে অনেক ভালো কাজ করছে পুলিশ। কিন্তু দু-একজন পুলিশ কর্মকর্তার কারণে পুলিশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist