বিশেষ প্রতিনিধি
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
বাঙালির ভাষা আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে এক দিন ভাগ হয়েছিল যে দেশ, সেদিনই বপন হয়েছিল এ আন্দোলনের প্রথম বীজ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দাবি এক দিন গণদাবি হয়ে রূপ নেয় আন্দোলনে। অবশেষে এক দিন রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। ভাষার জন্য শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিউরসহ নাম না জানা সোনার ছেলেরা।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে পথে নামা মিছিলে ছিলেন ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন। তখন তার বয়স ২৬। পুলিশের হামলায় ছাত্রদের সঙ্গে রফিকও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ব্যারাকে আশ্রয় নেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে তার মাথার খুলি ওড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েন তিনি। মেডিক্যাল হোস্টেলের ১৭ নম্বর কক্ষের পূর্বদিকে কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় অ্যানাটমি হলের পেছনের বারান্দায়। সবার অজ্ঞাতে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানের অসংরক্ষিত স্থানে। রফিকের বাবা আবদুল লতিফ এবং মা রাফিজা খাতুন। জন্ম মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামে। ১৯৫২ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেদিনের মিছিলে ছিলেন ভাষা শহীদ আবুল বরকতও। হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত ৮টায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সে রাতেই আজিমপুর কবরস্থানে মৃতদেহ দাফন করা হয়। তার বাবা শামসুদ্দিন, মা হাসিনা বেগম। জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি। ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের জন্ম ১৩২৬ বাংলা, ২৬ আশ্বিন, ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার পাঁচাইর গ্রামে। শাশুড়িকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। ঢাকা মেডিক্যালে শাশুড়িকে ভর্তি করে নিজে ওঠেন ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁওয়ের হুরমত আলীর ২০/৮ নম্বর কক্ষে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে, কী হয়েছে দেখার জন্য কক্ষ থেকে বের হয়ে ছাত্রদের কাছে দাঁড়াতেই গুলিবিদ্ধ হন জব্বার। চিকিৎসকরা জব্বারকে মৃত ঘোষণা করেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে ঢাকার রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসে যাচ্ছিলেন শফিউর রহমান। নওয়াবপুর রোডে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে গুলি তার পিঠে এসে লাগে। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মধ্যরাতে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ বরকতের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগর গ্রামে। বাবা মাহবুবুর রহমান। শহীদ শফিউর রহমান ঢাকা হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় কেরানি পদে চাকরি করতেন। মতিঝিলের ডাইরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজে পিয়নের চাকরি করতেন ভাষা শহীদ আবদুস সালাম। জন্ম ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভুয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মণপুর গ্রামে। তখন তার বয়স ২৭। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাস্তায় নামা মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন সংজ্ঞাহীন থাকার পর ৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েন। পরদিন সকালে জানাজা শেষে আজিমপুর গোরস্তানে তার লাশ দাফন করা হয়। শহীদ আবদুল আউয়ালের জন্ম ঢাকায়। ২২ ফেব্রুয়ারি শোক মিছিলে যোগ দেন আউয়াল। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে রাস্তায় এলে তৎকালীন সামরিক বাহিনীর একটি ট্রাক সেই মিছিলের মধ্যে ঢুকে পড়ে ও ট্রাকচাপায় মৃত্যু হয় তার। সে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ১০ বছরের কিশোর অহিউল্লাহ। বাবা হাবিবুর রহমান। পরে তার মৃতদেহেরও সন্ধান মেলেনি।
"