শাহ্জাহান সাজু

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট

হঠাৎ করেই তারল্য বা নগদ টাকার সংকটে ভুগছে দেশের ব্যাংকগুলো। এ কারণে অনেক ব্যাংক নতুন করে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো। প্রায় সব ব্যাংকই সুদের হারও বাড়িয়েছে। এমনকি আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়ছে ব্যাংকিং খাতে। গত কয়েক বছর ধরে আমানতে সুদের হার কম থাকার কারণেও ব্যাংকে টাকা রাখছেন না অনেক, এমনকি সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নিচ্ছেন টাকা। এসব কথা জানা গেছে ব্যাংকিং খাত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে।

এসব ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাজধানীর একটি হোটেলে গত শনিবার অগ্রণী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে গভর্নর বলেছেন, ‘একটি বেসরকারি ব্যাংক খারাপ অবস্থায় পড়ে গেছে। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত সরিয়ে নিতে চাচ্ছে। একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অহেতুক এটি করছে।’ তারা যাতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা না সরিয়ে ফেলে সেজন্য বিষয়টি অর্থমন্ত্রীকে দেখার কথা বলেছেন তিনি।

ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) নিয়ে ব্যাংক খাতে অহেতুক প্যানিক দেখা দিয়েছে। এর কোনো কারণ দেখছি না। এটি অত্যন্ত অমূলক আশঙ্কা। এডিআর কমানোর কারণে এখন সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে ১১ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ঋণ আছে। ঋণ আমানত অনুপাতের (এডিআর) বিষয়ে আগে বলা হয়েছিল সিআরআর (নগদ জমা সংরক্ষণ) ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণ) বাদ দিয়ে যে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে তার থেকে ব্যাংক নিজস্ব সিদ্ধান্তে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। এখন আমরা বলছি ব্যাংক ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে আরো ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আমাদের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৮টি ব্যাংক এর নিচেই আছে। অনেক বেসরকারি ব্যাংক অ্যাগ্রেসিভ ল্যান্ডিং (ঋণ প্রদান) করছিল এবং ন্যূনতম পরিমাণ ক্রেডিট ছিল না। এজন্য অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হয়েছে।

আমানত নিয়ে গভর্নর বলেছেন, আমানতের সুদ হার বাড়তে শুরু করেছে, এটা আমানতকারীদের জন্য ভালো। তবে ঋণের সুদ হার বাড়াটা ভালো না। এটা স্বল্প সময়েই ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বলেছেন, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ বন্ধ, ঋণের মান ভালো ও ঋণ শৃঙ্খলা নিশ্চিতে ঋণসীমা কমানো হয়েছে। তবে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট নেই বলে দাবি করেন গভর্নর ফজলে কবির।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক মাস আগেও ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়েছে। যা এখন ২ থেকে ৩ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে। একইভাবে বেড়ে গেছে ভোক্তা ও গৃহ ঋণের সুদের হারও। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি বৈঠক করে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট এবং ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, তারল্য সংকট তো মাঝে মাঝে হতেই পারে। এতে চমকে উঠার কিছু নেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে তা আবার ঠিকও হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা চাই ঋণের সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে থাকুক। তবে নানা কারণে এই বছরটি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং দেশে পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাই ডলার এবং টাকা দুটোর ওপই চাপ রয়েছে। কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে। তাই যারা দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে বিনিয়োগ করেছেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে; তারা যেন তা সহনীয়ভাবে পরিশোধ করতে পারেন, সেই দিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারল্য সংকটের কারণে বিভিন্ন জনের কাছে ধরনা দিচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এমনকি অফার করা হচ্ছে বাড়তি সুদও। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের এমন অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি বলেও মন্তব্য করেছেন কোনো কোনো ব্যাংকার। তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। নিয়ম না মেনেও কোনো কোনো ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে। যেটি পুরো ব্যাংকিং খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণপ্রবাহ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনার কারণেও অনেক ব্যাংক নতুন ঋণ দিতে পারছে না। অনেকে আবার নির্ধারিত ঋণসীমার মধ্যে আসতে বিতরণকৃত ঋণও ফেরত আনার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে সবাই আমানত সংগ্রহে জোর দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ৩০ জানুয়ারি ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত বা এডিআর নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য অগ্রিম আমানত হার সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক এবং প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য বিনিয়োগ আমানত হার বা এডিআর সর্বোচ্চ ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ৮৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তা ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরের জুন শেষে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন শ্লথ থাকায় ব্যাংকগুলো এই তারল্যের বড় অংশই স্বল্প সুদের বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করে রেখেছে। ব্যাংকগুলো আড়াই শতাংশেরও কম সুদে ৭ দিন, ১৪ দিন ও ৩০ দিন মেয়াদে বিনিয়োগ করেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ঋণপ্রবাহ অনেক বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে। গড়ে প্রতি মাসে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ থেকে ১১ শতাংশ। আমানতের তুলনায় ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। অক্টোবরে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ দশমিক ৬৩, সেপ্টেম্বরে ছিল ১৯ দশমিক ৪০, আগস্টে ছিল ১৯ দশমিক ৮৪ এবং জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণ ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ঋণ দিতে পারে। তবে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকেরই ঋণ ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আগ্রাসী বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন গভর্নর।

জানা যায়, আমানতকারীদের আকর্ষণ করতে নতুন বছরে বেশিরভাগ ব্যাংক আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন সুদ হার অনুযায়ী, কয়েকটি ব্যাংক শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist